পঞ্চম অধ্যায়ঃ ইসলামী বিশ্বদর্শন ও কর্মকৌশল
পঞ্চম অধ্যায়
ইসলামী বিশ্বদর্শন ও কর্মকৌশল
সেকুলার বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিশ্বদর্শনভিত্তিক কর্মকৌশল অবলম্বন করে উন্নয়নশীল এবং ধনাঢ্য পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো কী কারণে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়নি প্রথম চারটি অধ্যায়ে তা আলোচিত হয়েছে। সে কারণে মুসলিম দেশগুলো যদি ‘মাকাসিদ আল-শরীয়াহ’ হাসিল করতে চায়, তাহলে তাদের এসব কর্মকৌশলকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই; কেননা ‘মাকাসিদ আল-শরীয়াহ’-তে স্বাভাবিক মানবকল্যাণের উপাদানসমূহ এতই ব্যাপক যে, অন্য কোনো সেকুলার ব্যবস্থায় তা কল্পনাও করা যায় না। এমনকি কী করতে হবে সে ব্যাপারে কালক্ষেপণের সময়ও মুসলিম দেশগুলোর নেই। ইতোমধ্যেই যথেষ্ট ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। তারা যদি মাকাসিদ অর্জনের উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার না দেয়, তাহলে আর্থ-সামাজিক অসন্তোষ আরো ঘনীভূত হবে। ফলে তাদের সমাজ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়বে।
অতএব মুসলিম দেশগুলোর প্রয়োজন এক ভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার, যে ব্যবস্থা ভ্রাতৃত্ব ও মানবকল্যাণের সকল প্রয়োজনীয় উপাদান নিশ্চিত করতে সক্ষম। এ ব্যবস্থা ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণেই সক্ষম হবে না, বরং তা সম্পদের এমনভাবে পুনর্বণ্টন করবে, যাতে একই সঙ্গে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা উভয়ই অর্জিত হয়। এ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকরীগণ এর নীতিমালাসমূহ মেনে চলবে এবং তাদের সর্বোত্তম গুনাবলীর বিকাশ ঘটাবে। এতে তারা শুধু নিজের স্বার্থই নয়, বরং সমাজের স্বার্থও রক্ষা করবে। এ ব্যবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত সফল হবে না, যতক্ষণ না তা ব্যাপক আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পুনর্গঠনের মাধ্যমে সমাজের দুরূহ হতে পারে, যদি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে সমাজের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোকে এমনভাবে উপযোগী করে তোলা না হয়, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ ব্যবস্থার মূলনীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে অবৈধ সুবিধা নিতে পারে।
দুর্লভ সম্পদ ও তার বণ্টনের মধ্যে এমনভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, যাতে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা উভয়ই অর্জিত হয়। এ জন্য যা দরকার, তা হলো রাষ্ট্র বা বাজারের উপর গুরুত্ব না দিয়ে মানবগোষ্ঠীর উপর নজর দেয়া। মানুষ একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জীবন্ত ও অপরিহার্য উপাদান। লক্ষ্য ও লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার সবই মানুষ। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সামাজিক কল্যাণের লক্ষ্যে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আত্মস্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে তাদেরকে সংশোধিত ও উদ্বুদ্ধ করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাজার অর্থনীতির ‘অদৃশ্য হাত’ অথবা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ‘দৃশ্যমান হাত’ দ্বারা আর্থ-সামাজিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কিছুতেই সফল হতে পারবে না। এককভাবে মানুষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তার প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে অনুপ্রেরণা পায়। সুতরাং, সংস্কার হতে হবে এমন যা অর্থব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করে, জীবনাচার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত শক্তিকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করে, যাতে সম্পদের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ কমিয়ে আনা যায় এবং অন্যায়, শোষণ ও অস্থিতিশীলতা সম্পূর্ণ নির্মূল করা না গেলেও ব্যাপকভাবে হ্রাস করা যায়। এগুলো যদি না করা যায়, তাহলে কোনো একক মানুষের সংস্কার কার্যকর হতে পারে না। অতএব মানুষ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। এ উভয় বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো ব্যবস্থার কর্মকৌশলে যখন কেবলমাত্র বাজার শক্তি বা রাষ্ট্রের উপর প্রধানত জোর দেয়া হয়, তখন শেষ পর্যন্ত তা মানুষের অধঃপতন ডেকে আনে ও দুর্দশা বৃদ্ধি করে, হতে পারে, তা মানুষের সমস্যার সমাধানের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই করা হয়।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি বিশ্বদর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে না উঠলে মানুষ ঐ ব্যবস্থার লক্ষ্য এবং তা অর্জনের উপায় হতে পারে না। কারণ এ দর্শন সমস্ত বিবেচনার কেন্দ্রবিন্দুতে গুরুত্বের ঈর্ষণীয় অবস্থানে মানুষকে পুনঃস্থাপিত করে এবং তাকে কেন্দ্র করেই সমস্ত কিছু আবর্তিত হয়। পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী কোনো বিশ্বদর্শনেই মানুষকে এ ধরনের গুরুত্ব দেয়া হয়নি এবং ডারউইনবাদ বা দ্বান্দ্বিকতাবাদে মানব ভ্রাতৃত্ববোধ, আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সম্পদের আমানতের প্রকৃতির বিষয়ে যে অন্তর্নিহিত বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন তাও স্থান পায়নি। এতে ‘যোগ্যতমরাই সেরা’ অথবা ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ এবং ‘চাহিদার সর্বোচ্চ তৃপ্তি’ বা ‘জীবনের বস্তুবাদী অবস্থা’ ইত্যাদি বিষয়ের উপর অত্যধিক ও অতিরঞ্জিত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসব দর্শনে সমাজের স্বার্থে কাজ করার জন্য মানুষকে নিয়োজিত করার কোনো উদ্বুদ্ধকরণমূলক ব্যবস্থা নেই। সমাজের স্বার্থ কেবল আত্মস্বার্থ সিদ্ধি ও প্রচেষ্টার মাঝেই নিহিত নয়, বরং সে জন্য অন্যের উপকারার্থে ব্যক্তিগত লাভ ও আয়েশ বিসর্জন দেয়ারও প্রয়োজন। এসব বিশ্বদর্শন সংঘাত ও অধিকারের দাবিকেই জোরালো করে এবং শুধু সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে অদক্ষতা ও অবিচারেরই জন্ম দেয় না, তা স্বপ্নভঙ্গ, অপরাধ, পারিবারিক ও সামাজিক ধস এবং পরিশেষে মানুষের অধঃপতনও ডেকে আনে।
অর্থ ও ব্যাংকব্যবস্থা আধুনিক কালের অর্থনীতির উপর এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে যে, এদের ইতিবাচক সমর্থন ছাড়া কোনো অর্থব্যবস্থা তার শক্তি ও সামর্থ্যকে ধরে রাখতে বা আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে না। সুতরাং, সকলের জন্য ক্ষতিকর অতিরিক্ত ভোগ, বেকারত্বও মুদ্রাস্ফীতি যাতে ঘটতে না পারে, তেমনি ভারসাম্যহীনতা ও বাড়াবাড়িকে পরিহারকল্পে অর্থ ও ব্যাংকব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। সাধারণভাবে এ ব্যবস্থা এমন হতে হবে যাতে প্রয়োজন পূরণ করা যায়, উচ্চহারে উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি এবং উৎপাদন ব্যবস্থার ব্যাপকভিত্তিক মালিকানা নিশ্চত হয়। এ ধরনের একটি সুস্থ ও ন্যায়বিচারমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করা কি সম্ভব? এ অধ্যায়ের মূল লক্ষ্য এ কথারই ই্ঙ্গিত দেয় যে, হ্যাঁ, তা করা সম্ভব। এ ব্যবস্থার শিকড় নিহিত থাকবে ইসলামী বিশ্বদর্শনে। একে কিভাবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালায় রূপান্তরিত করা যায়, সে সম্পর্কে ষষ্ঠ থেকে একাদশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ইসলামের বিশ্বদর্শন ও কর্মকৌশল মাকাসিদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এ দর্শন কৌশল মুসলিম দেশগুলো যেসব সমস্যার সম্মুখীন, তার একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কার্যকর সমাধানের নীলনকশা প্রদানে সক্ষম। তবে এজন্য ইসলামের শিক্ষাসমূহ অনুসরণ ও সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা জরুরি। যেহেতু বহু মুসলিম দেশের অর্থনীতি এখনো উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, সেহেতু তাদের অর্থব্যবস্থা ও অর্থনীতির জন্য একটি নতুন নকশা ও দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। অবশ্য কাল পরিক্রমার সাথে সাথে তা করা উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশ্ববীক্ষণ
ইসলাম একটি সাধারণ সহজবোধ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য সার্বজনীন বিশ্বাসের নাম। এর ভিত্তি তিনটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত: তাওহীদ (একত্ববাদ), খিলাফত (প্রতিনিধিত্ব) ও আদল (ন্যায়বিচার)। এ নীতিমালা ইসলামী বিশ্বদর্শনের শুধু কাঠামোই তৈরি করে না, তা মাকাসিদ ও কর্মকৌশলের উৎস হিসেবেও কাজ করে। অতএব, এতে বহুত্ববাদী দল বা সামাজিক শ্রেণীসমূহের পরস্পর বিরোধী দাবির মুখে কোনোরকম জোড়াতালি বা পশ্চাৎ চিন্তার সুযোগ নেই। ইসলামী বিশ্বদর্শন, মাকাসিদ এবং কর্মকৌশলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এতে সংগতিপূর্ণ নীতি প্রণীত হয় এবং এদের পরস্পরের মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় বিরাজ করে। যারা এসব ধারণার সাথে পরিচিত নয়, তাদের জন্য এবং লক্ষ্য অর্জনে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য কিভাবে ইসলামী বিশ্বদর্শন, মাকাসিদ ও কর্মকৌশলকে একটি সংগতিপূর্ণ নীতিতে সমন্বিত করা যায়, সে উদ্দেশ্যে এ তিনটি মৌলিক নীতির অর্থ ও গুরত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আবশ্যক।
তাওহীদ
তাওহীদ (আল্লাহর একত্ব ও একতা) ইসলামী বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর। এ ধারণার উপরই গড়ে উঠেছে সামগ্রিক বিশ্বদর্শন ও কর্মকৌশল। অন্য সব কিছুই যৌক্তিকভাবে এর থেকে সৃষ্ট। এর অর্থ হচ্ছে, একটি সর্বশক্তিমান সত্তা, যিনি এক এবং অদ্বিতীয়, এ বিশ্বকে সচেতনভাবে পরিকল্পনা ও সৃষ্টি করেছেন এবং তা হঠাৎ করে বা দুর্ঘটনাবশত সৃষ্টি হয়নি (কোরআন-৩:১৯১, ৩৮:২৭ ও ২৩:১৫)। তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার পিছনে একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। এ উদ্দেশ্যেই এ বিশ্বের অস্তিত্বের অর্থ ও গুরুত্ব বহন করে। মানুষ তারই একটি অংশ। বিশ্ব সৃষ্টির সর্বোচ্চ সত্তা অবসর গ্রহণ করেননি। বিশ্বব্যবস্থার প্রতিটি কার্যক্রম তিনি সক্রিয়ভাবে দেখাশুনা করছেন (কোরআন-১০:৩ এবং ৩২:৫) এবং এর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা সম্পর্কে তিনি সচেতন ও সচেতন ও খোঁজ রাখেন (কোরআন-৩১:১৫ ও ৬৭:১৪)।’
খিলাফত
মানবসত্তা পৃথিবীতে তার খলিফা বা প্রতিনিধি (কোরআন-২:৩০, ৬:১৬৫, ৩৫:৩৯, ৩৮:২৮ ও ৫৭:৭০) এবং তার উপর অর্জিত দায়িত্ব যাতে কার্যকরভাবে পালন করতে পারে, সেজন্য তাকে সব ধরনের আধ্যাত্মিক, মানসিক ও বস্তুগত সম্পদে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়েছে। খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালনে ইচ্ছা করলে সে স্বাধীনভাবে চিন্তভাবনা করে ভুল বা সঠিক এবং ন্যায় বা অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা মানুষের জীবনের অবস্থা, তার সমাজ বা ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে দিতে পারে। প্রকৃতিগতভাবে সে ভালো হওয়ার সে সুখি ও পরিতৃপ্তবোধ করে, যতক্ষণ সে অনড় থাকে অথবা তার অন্তর্গত প্রকৃতির আরো সান্নিধ্যে পৌঁছায়; আর অসুখি ও দুর্দশাগ্রস্ত অনুভব করে, যখন সে এ থেকে বিচ্যুত হয়।
আল্লাহতায়ালা এ বিশ্বকে যে সম্পদে সমৃদ্ধ করেছেন তা সীমাহীন। দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ব্যবহার করলে সকলের কল্যাণের প্রয়োজন মিটানোর জন্য তা যথেষ্ট। এসব সম্পদ কিভাবে ব্যবহৃত হবে একজন মানুষ তা নিজেই নির্ধারণ করতে পারে। তবে যেহেতু সেই একমাত্র খলিফা নয় এবং কোটি কোটি মানব সন্তান যারা তারই মতো খলিফা এবং তার ভাইও তার সমান, সেহেতু তার সত্যিকারের পরীক্ষা সকল মানুষের কল্যাণে (ফালাহ) আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের দক্ষ ও সমতাভিত্তিক ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত। এটা করা সম্ভব তখনই, যখন তা করা হয় দায়িত্ববোধ ও মাকাসিদ এবং আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনা ও নিষেধাজ্ঞার আলোকে।
তাওহীদ ও খিলাফতের ধারণা সহজাতভাবে অন্যসব ধারণা যেমন: ‘জন্মগত ভাবে পাপী’ বা ‘ইতিহাসে দাবার ঘুঁটি’, ‘জন্মকালে অলিখিত ফলক’ অথবা ‘মুক্ত থাকার জন্যই জন্ম’-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। করুণাময় মহান আল্লাহ কেন ‘জন্মগতভাবে পাপী’কে সৃষ্টি করবেন এবং নিজের কোনো দোষ না থাকলেও কেন তাকে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত করবেন? কান্ট যথার্থই উল্লেখ করেছেন, ‘মানব ইতিহাসে নৈতিক দুর্বৃত্তি ও তার অবিরাম বিস্তার লাভ সম্পর্কে এটি সবচেয়ে বাজে ধারণা যে, তা উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের আদি পিতা-মাতার নিকট থেকে এসেছে’। মূল ‘পাপের ধারণা’ থেকে অর্থ দাঁড়ায় এটা যে, পাপ-পুণ্য প্রজনন প্রক্রিয়ায় হস্তান্তরযোগ্য এবং প্রত্যেক মানুষ অন্যের ব্যর্থতা এবং পাপের প্রভাবেই দুনিয়াতে আগমন করে। উপরন্তু, যে ‘মূল পাপ’ সে নিজে নিজে করেনি, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য কোনো ‘ত্রাণকর্তা’র যদি আসতেই হয় তবে পৃথিবীতে প্রথম মানব সন্তানের আগমনের সাথে সাথে না এসে কেন সে এত দেরিতে আসবে? মানুষ যদি জন্মগতভাবে পাপী হয় তাহলে কিভাবে তার কৃতকর্মের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে? ‘মূল পাপ’ এর ধারণাটি এভাবেই পবিত্র কোরআনে দ্ব্যার্থহীনভাবে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মফলের উপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তার সঙ্গে প্রবলভাবে সাংঘর্ষিক (উদাহরণ-৬:১৬৪, ১৭:১৫, ৩৫:১৮; ৩৯:৭ ও ৫৩:৩৮)। লুইস যথার্থভাবেই উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের ধারণা ‘দায়িত্ববোধকে অস্বীকার করে বিরাট ক্ষতি করতে পারে’। ‘মূল পাপ’ এর ধারণাটি একজন মুলমান প্রায়শ যে মহান দয়ালু ও করুণাময় (আর-রাহমান ও আর-রহীম) আল্লাহর নাম জপ করে, তার গুণাবলীর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এটা মানুষের বুদ্ধির অগম্য যে, এমন একজন দয়ালূ প্রভু কেন তাদের প্রথম পিতামাতার পাপ সমগ্র মানবজাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন। তিনি করুণাময় ও ক্ষমাশীল এবং যা কিছু ভালো গুণের কল্পনা করা যায় তার সবই তার মধ্যে আছে। সুতরাং, এ ধরনের কাজ করা তার জন্যে অসম্ভব (কোরআন-৭:১৮০)। আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই যে, প্রায় সকল আধুনিক দার্শনিকদের মতো উনবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী ও রোমান্টিক ব্যক্তিবর্গ মানব প্রকৃতির সহজাত দুর্বলতার মূলপাপের ধারণাটি পরিত্যাগ করেছিলেন।
অনুরূপভাবে পারিপার্শ্বিক শক্তিকে প্রভাবিত করে নিজ ভাগ্য নির্ধারণে সক্ষম একটি স্বকীয় অমর আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকারকারী পশ্চিমা তত্ত্বসমূহের ‘বন্ধকী’ ও ‘জন্মলগ্নে অলিখিত ফলক’ ধারণাসমূহ মানবসত্তাকে তুচ্ছতায় পরিগণিত করেছে। এসব তত্ত্বের মর্মকথা হলো, মানুষের মন একটি চিহ্নহীন স্লেটের মতো, যার উপর বহিস্থঃ কার্যকরণগুলো পছন্দ মাফিক ছাপ রেখে যায়। এ মত অনুযায়ী মানবসত্তা অসহায় ও অসাড়; বেঁচে থাকার জন্য তাদের জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। তাদের জীবন ইতিহাস জড় শক্তি দ্বারা নির্ধারিত অথবা মনস্তাত্ত্বিক (ফ্রয়েড), প্রবৃত্তিজাত (লরেঞ্জ), এবং পরিবেশগত (প্যারলভ, ওয়াটসন, স্কিননার ও অন্যান্য) প্রভাব দ্বারা নিয়োজিত। স্কিননারের সুরে সুর মিলিয়ে এ দৃষ্টিভঙ্গি এ সাক্ষ্যই দেয় যে, ‘একক স্বাধীনতা সাধন হতে পারে না। নিয়তিবাদ মানুষের মর্যাদাকে শুধু অবনমিতই করে না, তা বিরাজমান পরিস্থিতি এবং সম্পদের অন্যায্য ও অদক্ষ বিতরণের জন্য মানুষের দায়িত্বশীলতাকেও অস্বীকার করে।
নিয়তিবাদ বলে, আত্মিক শক্তিসমূহ, সামাজিক কাঠামো এবং জীবনের বস্তুগত অবস্থানের পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে না। কিন্তু মানবসত্তা যদি অসাড় হয় এবং তাদের জীবন যদি নিয়ন্ত্রিত ও পূর্ব-নির্ধারিত হয়, তবে কে এ পরিবর্তন আনবে? তাছাড়া, জীবন যদি পূর্ব-নির্ধারিত হয়, তাহলে ‘বিচ্ছিনতাবোধ’ও এর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং বুর্জোয়া বা প্রোলেতারিয়েত কাউকেই এর জন্যে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। তাহলে শ্রমিক শ্রেণীর ‘বিচ্ছিন্নতাবোধে’র জন্য বুর্জোয়া শ্রেণীকে দোষ দেয়া হবে অথবা শ্রমিক জাগরণের আহবান জানানো হবে? মানব অস্তিত্বের পূর্ব-নির্ধারিত প্রকৃতি সংজ্ঞায়িত করলে মানব প্রচেষ্টা দ্বারা তা অপরিবর্তনীয়। বুর্জোয়া শ্রেণী ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি উৎখাত করে তার স্থলে রাষ্ট্রীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মার্কসীয় সুপারিশ পলিটব্যুরো কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া মানব জীবনে আর এক ধরনের নিয়তিবাদের প্রচলন ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়।
নিয়িতবাদীদের বিপরীত প্রান্তে সার্ত্রের ভোগবাদের অবস্থান। সেখানে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই এবং মানুষের স্বাধীনতা সীমাহীন; কেবল সে অবিরাম স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারে না। মানুষের মানসিক জীবনের প্রতিটি দিক ইচ্ছাকৃত, নির্বাচিত এবং নিয়ত দায়িত্বাবদ্ধ। নিঃসন্দেহে এ ধারণা নিয়তিবাদের চেয়ে ভালো। তবে সার্ত্রের মতে, এ স্বাধীনতার নিরঙ্কুশ সব কিছুই অনুমোদিত। মানব জীবনের সহজাত কোনো উদ্দেশ্য বা চুড়ান্ত লক্ষ্য নেই। মানবসত্তার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক বা বিষয়সম্মত মূল্যবোধ নেই, তা সে স্রষ্টার আইন বলি কিংবা স্বর্গীয় প্রেম বা অন্য বিছু বলি না কেন। মানবসত্তা এ পৃথিবীতে বিকৃত এবং পরিত্যক্ত, যেখানে তারা সম্পূর্ণভাবে নিজেরাই নিজেদের দেখাশোনা করবে। মূল্যবোধের একমাত্র ভিত্তি মানুষের স্বাধীনতা অনুরণের জন্য কেউ মূল্যবোধ বাছাই করে নেবে এর কোনো বাস্তব যুক্তি থাকতে পারে না। নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার এ ধরনের ধারণা কেবল পুঁজিবাদী ধরনের লেইজে ফেয়ার ও মূল্যবোধ নিরপেক্ষতার সৃষ্টি করবে। সেখানে সম্মত মূল্যবোধের কোনো প্রশ্নের উদয় হবে না, অথবা ব্যক্তি ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে ঐকতান সৃষ্টির জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে না, অথবা সম্পদের দক্ষ সুষম বণ্টনের প্রশ্ন দেখা দেবে না, যার কোনো কিছুই বাজার দ্বারা আপনাআপনি ঘটানো সম্ভব নয়।
এ ধারণাসমূহের সম্পূর্ণ বিপরীত খিলাফতের ধারণা বিশ্বে মানবসত্তাকে একটি সম্মানজনক ও মহিমান্বিত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে (কোরআন-১৭:৭০) এবং মানব-মানবীর জীবনকে একটি অর্থ ও লক্ষ্য প্রদান করেছে। এ অর্থ একটি দৃঢ় বিশ্বাসের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে যে, তাদেরকে বৃথা নয় বরং একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে (কোরআন-৩:১৯২, ৩:১৯২, ২৩:১১৫)। তাদের জীবনের ব্রত হচ্ছে, স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও ঐশী পদ্ধতি অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। ইসলামী মতে ‘ইবাদত’ বা উপাসনা বলতে এটিই বুঝানো হয়েছে (কোরআন- ৫১:৫৬) যার অলঙ্ঘনীয় অনুজ্ঞা হচ্ছে অন্যান্য মানুষের প্রতি কোনো মানুষের দায়িত্ব পালন (হাক্কুল ইবাদ), তাদের আশ্চর্যের কিছু নেই যে, কতিপয় মহান ধর্মের মতো ইসলামে অধিকারের চেয়ে দায়িত্বের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর পিছনে মৌলিক যুক্তি হলো, যদি প্রত্যেকে দায়িত্ব পালন করে, তবে প্রত্যেকের নিজ স্বার্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে অর্জিত হবে এবং সকলের অধিকার নিঃসন্দেহে সুরক্ষিত থাকবে। এ ব্রতের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ন্যায়বিচারক, দয়ালু ও করুণাময় সৃষ্টিকর্তা এবং তার নির্দেশনার প্রতি পরিপূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি। মানবসত্তা অবশ্যই তাকে ছাড়া আর কারো কাছে নত হবে না, আর কারো মূল্যবোধ মানবে না এবং আর কারো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বেঁচে থাকবে না। এ পৃথিবীতে তাদের সকল কর্মের জন্য তারা তার কাছে দায়ী থাকবে। অবশ্যই তারা শুধু নিজের কাজের জন্যই দায়ী থাকবে (কোরআন-৬:১৬৪, ১৭:১৫ ও ৩৫:১৮) এবং তাদের নিজেদের কারণে যতটুকু সুসংঘটিত হয়েছে, ততটুকু ছাড়া অন্যদের অতীত বা বর্তমান, বাকি কোনো কাজের জন্যই দোষী সাব্যস্ত হবে না, যেখানে এ পৃথিবীতে যেভাবে তারা দায়িত্ব পালন করেছে, তার উপর ভিত্তি করে তাদেরকে পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করা হবে। এভাবেই তাদের জীবন ‘সৌর ব্যবস্থার বিশাল নক্ষত্রের মতো কালক্রমে নিভে যাবার মতো নয়’, এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের হতাশব্যঞ্জক অনুভব ‘মানুষের অর্জনের সমস্ত মন্দিরটি এ বিশ্বে ধ্বংস স্তূপের নিচে তলিয়ে যাবে”। এও সত্যিকার বাস্তবতা নয়। খিলাফতের যে ধারণা তার বেশ কিছু সংশ্লেষ বা অনুসিদ্ধান্ত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে;
১.বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব
খিলাফতের অর্থ মানবজাতির মৌলিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব। প্রত্যেকেই খলিফা এবং কোনো দেশ, দল বা বিশেষ কোনো জাতির সদস্য বা কোনো বিশেষ সুবিধাভোগী ব্যক্তি নয়। এটি সাদাকালো, উঁচুনিচু সকল মানবসত্তার সামাজিক সাম্য ও মহত্ত্বকে ইসলামী বিশ্বাসের মৌলিক উপাদানে পরিগণিত করেছে। মানুষের মর্যাদা নির্ধারণের মানদণ্ড তার জাতি, পরিবার বা সম্পদ নয়; বরং তা হচ্ছে তার চরিত্র ও মানবতার প্রতি সেবা (যা তার বিশ্বাস ও অনুশীলনের প্রতিফলন)। রাসূলুল্লাহ (স) সুস্পষ্ট করে বলেছেন, ‘সমস্ত মানবসত্তাই আল্লাহর ভৃত্য এবং আল্লাহর নিকট তারাই সবচেয়ে বেশি প্রিয়, যারা তার ভৃত্যদের মধ্যে সর্বোত্তম’।
ভ্রাতৃত্বের এ ধারণাগত কাঠামোর আওতায় অন্যান্য মানবসত্তার প্রতি সঠিক মনোভাব ‘জোর যার মুল্লুক তার’, ‘কেবল আত্মস্বার্থ রক্ষার্থে সংগ্রাম’ অথবা ‘যোগ্যতমরা সেরা’ নয়, বরং তা হচ্ছে সকলের মৌলিক চাহিদা পূরণ, সমগ্র মানবিক সম্ভাবনাকে উন্নত করা এবং মানব জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্য পারস্পরিক কোরবানী ও সহযোগিতার মনোভাব। প্রতিযোগিতাকে ততক্ষণ পর্যন্ত উৎসাহিত করা যায় যতক্ষণ তা সুস্থ থাকে, দক্ষতা বৃদ্ধি করে এবং ইসলামের সার্বিক উদ্দেশ্য মানবকল্যাণে সহায়তা করে। যখনই তা সীমালঙ্ঘন করে, প্রতিহিংসা ও দাম্ভিকতার জন্ম দেয় এবং নৃশংসতা ও পারস্পরিক ধ্বংসের কারণ হয়, তখনই তা সংশোধন করতে হবে।
২. সম্পদ একটি আমানত
মানুষের কাছে প্রাপ্ত সকল সম্পদই যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত, সেহেতু খলিফা হিসেবে মানুষ এর মূল মালিক নয়, সে শুধু আমানতদার (আমীন)। এ আমানতদারিত্ব (আমানা) যখন ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অস্বীকৃতি’ বুঝায় না, তখন তাতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লেষ থাকে। এ সংশ্লেষগুলো অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ইসলামে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা সম্পর্কিত ধারণার মধ্যে এক বৈপ্লবিক পার্থ্যক্যের সৃষ্টি করে।
প্রথমত, সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জন্য নয়, সকলের উপকারের জন্য (কোরআন-২:২৯)। তা অবশ্যই সকলের কল্যাণে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেককে অবশ্যই বৈধভাবে সম্পদ অর্জন করতে হবে, যেমনভাবে কোরআন ও সুন্নাহতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এর অন্যথা হলে তা খিলাফতের দায়িত্বের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।
তৃতীয়ত, সম্পদ বৈধভাবে অর্জিত হলেও তা আমানতের শর্তের বাইরে ব্যয় করা যাবে না। আর এ আমানতদারিত্ব হচ্ছে শুধু নিজের এবং নিজের পরিবারের কল্যাণ নয়, অন্যের কল্যাণও বটে। একজন আমানতদার হিসেবে মানুষের জন্য এটি শোভন নয় যে, সে স্বার্থপর, সম্পদ লোভী ও বিবেকবর্জিত হবে এবং শুধু নিজের কল্যাণেই কাজ করবে।
চতুর্থত, কেউই আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ ধ্বংস বা অপচয় করার অধিকারী নয়। এ ধরনের কাজকে কোরআন ফাসাদ সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেছে (দুরাচার, দুর্বৃত্তি ও অসততা)। আল্লাহ ফাসাদকে ঘৃণা করেন (কোরআন-২:২০৫)। যখন প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) ইয়াযিদ-বিন-আবু সুফিয়ানকে কোনো এক যু্দ্ধের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন, তখন তিনি তাকে বাছবিচার না করে হত্যা করতে এবং এমনকি শত্রু দেশের শস্যক্ষেত বা জীবজন্তু ধ্বংস করতে নিষেধ করেছিলেন। যুদ্ধকালে শত্রু ভূখণ্ডেই যদি এ ধরনের কাজ অনুমোদিত না হয়, তা হলে শান্তিপূর্ণ সময়ে নিজের দেশে তা অনুমোদিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অতএব মূল্য বৃদ্ধি বা উচ্চমূল্য বজায় রাখার স্বার্থে জ্বালিয়ে দিয়ে বা সাগরে নিক্ষেপ করে উৎপাদিত পণ্য ধ্বংস করার বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ নেই।
৩. সাদাসিধে জীবন পদ্ধতি
আল্লাহর খলিফার জন্য গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবন পদ্ধতি হবে বিনীত। এতে কোনো ঔদ্ধত্য, জাঁকজমক ও আড়ম্বর অথবা নৈতিক শৈথিল্য প্রতিফলিত হবে না। এ ধরনের জীবন ধারণ পদ্ধতি অপব্যয় ও অপচয়ের কারণ হয় এবং সম্পদের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ বাড়ে। ফলে সবার চাহিদা পূরণে সামাজিক সক্ষমতা হ্রাস পায়।
এসবের ফলে অন্যায় পথে উপার্জনের রাস্তা তৈরি হয় এবং স্বাভাবিক বিতরণ ব্যবস্থার বাইরে আয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। অথচ দক্ষতা, উদ্যোগ, প্রচেষ্টা ও ঝুঁকির পার্থক্যের কারণে বিতরণে ইনসাফ বিধান নিশ্চিত করা দরকার। এসবের ফলে ন্যায়পরতার অনুভূতিতেও ধস নামে এবং মুসলিম সমাজের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. মানব স্বাধীনতা
মানবসত্তা আল্লাহর খলিফা হওয়ায় তারা আল্লাহর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবে না। সুতরাং, সামাজিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যাই হোক না কেন, সকল প্রকার দাসত্ব ইসলামে নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে, নবী মুহাম্মদ (স) এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই মানবজাতিকে বোঝা ও শৃঙ্খলামুক্ত করা- যা তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়ে থাকে (কোরআন-৭:১৫৭)। সে অনুসারে কারোর, এমনকি রাষ্ট্রেরও, কোনো অধিকার নেই এ স্বাধীনতা বাতিল করা এবং মানব জীবনকে কোনো প্রকার দাসত্ব বা শৃঙ্খলে বেধে ফেলা। এ শিক্ষই দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা)-কে একথা জিজ্ঞেস করতে উৎসাহিত করে, ‘মাতৃগর্ভ থেকে প্রত্যেক মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করলেও কখন থেকে তোমরা তাদের দাস বানিয়েছো’?
এর অর্থ এ নয় যে, মানুষ যা চাইবে তাই স্বাধীনভাবে করতে পারবে। তারা শরীয়াহর নিয়মে বাঁধা। শরীয়াহর লক্ষ্য হচ্ছে, প্রত্যেককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করা। অতএব, তারা ততটুকুই স্বাধীন যতটুকু শরীয়াহর সামাজিক দায়িত্বশীলতা নির্ধারণ করেছে। কোনো ব্যবস্থায় মানবসত্তাকে যদি সীমারেখার বাইরে অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেয়া হয়, তবে তা খিলাফতের ধারণায় যে মহত্ত্ব ও জবাবদিহিতা বিমূর্ত হয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না এবং তা মানবসত্তার কল্যাণে কোনো অবদান রাখতে পারবে না।
আদল (ন্যায়বিচার)
তাওহীদ ও খিলাফতের ধারণার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভ্রাতৃত্বের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার না থাকলে তা একটি অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা ধারণায় পর্যবসিত হবে। ন্যায়বিচারকে ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদগণ মাকাসিদ আল-শরীয়াহরও প্রশ্নাতীতভাবে অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করেছেন। এ ব্যাপারে তারা এতই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, ন্যায়বিচারহীন কোনো সমাজকে একটি আদর্শ মুসলিম সমাজ হিসেবে কল্পনা করাই অসম্ভব। মানব সমাজ থেকে জুলুমের সকল দিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে ইসলাম দ্ব্যর্থহীন। ইসলামের পরিভাষায় জুলুমকে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন ও অপকর্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এর সাহায্যেই একজন ব্যক্তি অন্য সকলকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অথবা তাদের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করে না।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সকল প্রকার অবিচার নির্মূল করাকে কোরআনে আল্লাহর রাসূলগণের প্রধান লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে (কোরআন-৫৭:২৫)। কম করে হলেও কোরআনে প্রায় শতাধিক স্থানে ন্যায়বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করা হয়েছে; কোথাও প্রত্যক্ষভাবে আদল, কিশত, মিজানের মতো শব্দ দ্বারা অথবা বিভিন্ন প্রকার পরোক্ষ বর্ণনা ও বর্ণনাভঙ্গির সাহায্যে। এছাড়া, জুলুম, ইজম, দালাল বা অন্যান্য শব্দের মতো শব্দসমষ্টি ব্যবহারের মাধ্যমে অবিচারের বিরুদ্ধে কোরআনে দুই শতাধিক স্থানে তিরস্কার করা হয়েছে। মূলত ইসলামী বিশ্বাসের গুরুত্ব অনুসারে কোরআনে ন্যায়বিচারকে আল্লাহ ভীতির পরেই স্থান দেয়া হয়েছে (কোরআন-৫:৮)। আল্লাহ ভীতিই স্বভাবত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর কারণে মানুষ ন্যায়বিচারসহ সকল ভালো কাজে প্রবৃত্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (স) ন্যায়বিচারের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। তিনি ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারাচ্ছন্নতার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘অবিচার থেকে সতর্ক হও, কারণ শেষ বিচারের দিনে তা গহীন অন্ধকারে নিয়ে যাবে’। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইবনে তাইমিয়া এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, ‘অবিশ্বাসী হলেও আল্লাহ ন্যায়বিচারকারী রাষ্ট্রকে রক্ষা করবেন এবং বিশ্বাসী হলেও অন্যায় আচরণকারী রাষ্ট্রকে রক্ষা করবেন না এবং বিশ্ব অবিশ্বাস ও ন্যায়বিচার নিয়ে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু ইসলাম অবিচার নিয়ে টিকে থাকতে পারে না’। ইসলাম ও অবিচার পরস্পর বিরোধী এবং যে কোনো একটির দুর্বল বা নির্মূল হওয়া ছাড়া একসঙ্গে চলতে পারে না। ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়বিচারের প্রতি ইসলামের দৃঢ় অঙ্গীকারের দাবি হচ্ছে, মানবসত্তার নিকট গচ্ছিত আল্লাহর পবিত্র আমানত সকল সম্পদকে মাকাসিদ আল শরীয়াহর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
শরীয়াহ সম্পর্কে আলোচনার কাঠামোর মধ্যে চারটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে: (১) চাহিদা, (২) আয়ের সম্মানজনক উৎস, (৩) সম্পদ ও আয়ের ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন এবং (৪) প্রবৃদ্ধি ও স্থিতি।
১. চাহিদা পূরণ
ভ্রাতৃত্বের মৌলিক সংশ্লেষ এবং সম্পদের আমানত প্রকৃতির বিষয়টি হচ্ছে, সম্পদ প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যবহার করতে হবে এবং প্রত্যেককে সম্মানজনক ও মানবিক মানের জীবন ধারনের নিশ্চয়তা দিতে হবে, আর তা হতে হবে স্রষ্টার খলিফা হওয়ার কারণে মানুষের সহজাত মর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নবী করিম (স) বলেছেন: ‘সে লোক ঈমানদার নয়, যে পেট ভরে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে’। যেহেতু সম্পদ তুলনামূলকভাবে সীমিত, তাই এ লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মানবতা ও সাধারণ কল্যাণের সীমানার মধ্যে সম্পদের উপর দাবি করা না হয়। চাহিদা পূরণ অবশ্যই এমনভাবে হতে হবে, যাতে জীবনধারণ খুব সাধাসিধে প্রকৃতির হয় এবং তাতে আরামআয়েশ থাকলে তা যেন অপচয় ও দাম্ভিকতার পর্যায়ে যেতে না পারে। ইসলামে এ ধরনের অপচয় নিষিদ্ধ হলেও মুসলিম দেশগুলোতে এর জোয়ার বইছে। ইসলামের চাহিদা পূরণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব প্রদানকে এভাবে দেখা ঠিক হবে না যে, সাম্প্রতিককালে এ বিষয়ে পশ্চিমা সমাজে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই ইসলামে একে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এটা প্রমাণিত যে, সমগ্র মুসলিম ইতহাসে ফিকাহ ও ইসলামী সাহিত্যের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আইনশাস্ত্রবিদগণ সর্বসম্মতভাবে এ মত পোষণ করেন যে, গরীবদের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ মুসলিম সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব (ফরজে কিফায়া)। মূলত শাতিবীর মতে, সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের অস্তিত্ব সমাজের নিজের অস্তিত্বের জন্যই প্রয়োজন (raison d’etre)। মওলানা মওদূদী, ইমাম হাসান আল-বান্না, সাইয়্যেদ কুতুব, মুস্তফা-আল-সিবা’ই, আবু জাহরাহ, বাকির আল-সদার, মুহাম্মদ-আল-মুবারক এবং ইউসুফ আল-কারযাভী সহ সকল আধুনিক পণ্ডিতগণ এ ব্যাপারে একমত।
২. সম্মানজনক উপার্জনের উৎস
খলিফার পদবীর সঙ্গে যে মর্যাদা সংযুক্ত করা হয় তার অর্থ হচ্ছে, চাহিদা পূরণ অবশ্যই প্রত্যেকের নিজের চেষ্টায় হতে হবে। সে অনুযায়ী আইনশাস্ত্রবিদগণ নিজের ও নিজের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য উপার্জন করাকে প্রত্যেক মুসলমানের ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ব্যতিরেকে কোনো মুসলমান এমনকি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্যও তার দৈহিক ও মানসিক পর্যাপ্ত সুস্থতা ও দক্ষতা রক্ষা করে চলতে পারে না। যেহেতু কোনো মুসলমান কর্মসংস্থান বা আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকলে সততার সঙ্গে উপার্জনের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম নাও হতে পারে, সেহেতু এ সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে, যোগ্যতা ও উদ্যোগের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রত্যেকের জন্য সৎ উপার্জনের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা মুসলিম সমাজের সামষ্টিক দায়িত্ব।
তা সত্ত্বেও কিছু লোক অবশ্যই থাকবে, যারা কোনো শারীরিক অবমতার কারণে নিজস্ব উদ্যোগে আয় করতে সক্ষম হবে না। এ ধরনের লোক যাতে কোনোরকম উপহাস বা পাল্টা অভিযোগের শিকার না হয়ে নিজেদের চাহিদা পুরণ করতে পারে, সে জন্যে তাদেরকে সাহায্য করা মুসলিম উম্মহার সামষ্টিক দায়িত্ব (ফরজে কিফায়া)। একটি গভীর বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর এ যৌথ দায়িত্ব পালনের ভার প্রথমে পড়বে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী ও আওকাফ বা মানবহিতৈষী সংগঠনগুলোর উপর। এ সমস্ত লোক বা সংস্থা যখন তা করতে সক্ষম হবে না, কেবলমাত্র তখনই রাষ্ট্র সে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এসব কর্মসূচির চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে, এভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত লোকেরা যাতে বেশি আয়ের মাধ্যমে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে তাতে সাহায্যে করা। তবে যতক্ষণ বাস্তবে রূপ না নিচ্ছে, ততক্ষণ এ ধরনের সম্পূরক আয়ের সাহায্য অবশ্যই থাকতে হবে। ইসলামে এ উদ্দেশ্যে বাধ্যতামূলক যাকাত (উশরসহ) এবং সাদাকা ও আওকাফের আকারে স্বেচ্ছাভিত্তিক দানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান প্রাপ্তির একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারের এখাতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ রাখা উচিত।
৩. আয় ও সম্পদের সমতাভিত্তিক বণ্টন
চাহিদা পূরণ সত্ত্বেও আয় ও সম্পদের চরম বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে। একটি মুসলিম সমাজে তখন বৈষম্য মেনে নেয়া যায়, যখন তা প্রথমত কমবেশি দক্ষতা, উদ্দ্যোগ, প্রচেষ্টা ও ঝুঁকির অনুপাতে হয়ে থাকে। যেখানে ইসলামী শিক্ষাসমূহ আন্তরিকভাবে অনুসৃত হয়, সেই সমাজে এগুলো সাধারণভাবে বণ্টিত হতে বাধ্য। চরম বা খুব বড় ধরণের বৈষম্য ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ ইসলামী শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হয় যে, সম্পদ কেবল সমগ্র মানবসত্তার জন্য আল্লাহর দানই নয় (কোরআন-২:২৯), তা একটি আমানতও বটে (কোরআন-৫৭:৭)। সুতরাং গুটিকতক লোকের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত থাকার কোনো কারণ নেই। বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে কার্যকর কর্মসূচি না থাকলে ইসলামের কাঙ্ক্ষিত ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি তরান্বিত করার পরিবর্তে ধ্বংসই এনে দেবে। অতএব, ইসলাম মূলত সম্মানজনক উপার্জনের উৎসের মাধ্যমে প্রত্যেকের চাহিদাই পূরণ করতে চায় না, বরং উপার্জন ও সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক বণ্টনের উপর গুরুত্ব প্রদান করে। কোরআনের ভাষায়, ‘সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়’ (কোরআন-৫৯:৭)।
ন্যায়ভিত্তিক বিতরণ বিষয়টিকে ইসলামে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, বেশ কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ এরূপ ধারণা পোষণ করেন যে, মুসলিম সমাজে সম্পদের সমতা অপরিহার্য। নবী করিম (স) এর একজন সাহাবী হযরত আবু জর (রা) এ ধারণা পোষণ করতেন যে, কোনো মুসলমানের তার পরিবারের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের মালিক হওয়া ঠিক নয়। তবে নবী করিম (স) এর অধিকাংশ সাহাবী তার এ চরম মতের সঙ্গে একমত হননি। অবশ্য আবু জর উপার্জনের সমতার কোনো প্রবক্তা নন। তিনি সম্পদের (সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ) সমতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি বলেন, এটা অর্জন করা সম্ভব, যদি ধনী লোকেরা নিজেদের প্রকৃত ব্যয় মিটানোর পর সমস্ত উদ্বৃত্ত সম্পদ তাদের কম সৌভাগ্যশালী ভাইদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য ব্যয় করে। মুসলিম পণ্ডিতগণের সাধারণ ধারণা হচ্ছে, সামাজিক আচরণ পদ্ধতি ও অর্থনীতি ইসলামের শিক্ষানুযায়ী পুনর্বিন্যস্ত করা হলে মুসলিম সমাজে সম্পদ ও আয়ের চরম অসমতা থাকতে পারে না।
৪. প্রবৃদ্ধি ও স্থিতি
মুসলিম উম্মাহর পক্ষে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে লভ্য সম্পদ ব্যবহার না করে চাহিদা পূরণ ও উচ্চ পর্যায়ের আত্মকর্মসংস্থান ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্য অর্জন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যুক্তিসংগত উচ্চহার অর্জন করা সম্ভব নয়। এমনকি সম্পদ ও উপার্জনের ন্যায়ভিত্তিক বণ্টনের লক্ষ্য বিত্তবান লোকদের পক্ষে আরো দ্রুত ও কম মূল্যে অর্জন করা সম্ভব, যদি উচ্চতর হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় এবং গরীব লোকেরা আনুপাতিক হারে সেই প্রবৃদ্ধির বৃহদাংশের সুবিধা ভোগ করতে সক্ষম হয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অধিকতর সাফল্য মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি এবং মূল্য ও বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে সৃষ্ট দুঃখ-দুর্দশা ও বৈষম্য হ্রাস করে। অতএব একটি মুসলিম সমাজ যা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্যারেটো অপটিমালিটির ধারণার উপর নির্ভরশীল নয় এবং শুধু নিজের প্রয়োজনেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দেয় না, সেখানে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সর্বনিম্নে রাখার জন্য ‘খিলাফত’ ও ‘আদল’-এর দাবি পূরণ করা প্রয়োজন।
কর্মকৌশল
এটা সুস্পষ্ট যে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের বিপরীতে ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে পরিপূর্ণ এবং তার অন্তর্নিহিত দর্শনের যৌক্তিক রূপায়ণ। ইসলাম শ্রেণীসমূহ ও বহুত্ববাদী দলগুলোর মধ্যে প্রভাব ও টিকে থাকার সংগ্রামের ফলে উদ্ভুত বিচ্ছিন্ন উপাদানের মতো কোনো জগাখিচুরি জিনিস তৈরি করে না। এ বিষয়গুলো ইসলামী ব্যবস্থার সঙ্গে এতই অবিচ্ছেদ্য যে, মুসলিম সমাজের ইসলামীকরণ কোন পর্যায়ে উন্নীত, তার পরিমাপের মানদ্ণ্ড এগুলোর দ্বারা নির্ধারিত হয়। অবশ্য এতে বিশ্বদর্শনের সঙ্গে লক্ষ্যসমূহের সমন্বয় যথেষ্ট নয়। এমন একটি কর্মকৌশল থাকা আবশ্যক যা অন্তনির্হিত দর্শনের যৌক্তিক ফল এবং ঐকান্তিকতার সঙ্গে কাজে লাগলে তা মুসলিম সমাজকে তার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করতে পারে। ইসলামে এ ধরনের একটি কর্মকৌশল আছে। এ কর্মকৌশলের মধ্যে রয়েছে চারটি অপরিহার্য ও পারস্পরিক শক্তিসঞ্চারী উপাদান, যার সাহায্যে সমগ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা যায়।
ক. একটি সমাজসম্মত বিশোধন কর্মকৌশল;
খ. সমাজ ও নিজের স্বার্থে প্রত্যেকের সর্বশক্তি নিয়োগের জন্য জোরলো উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থা;
গ. সম্পদের স্বল্পতা সত্ত্বেও ‘মাকাসিদ’ অর্জনের লক্ষ্যে সমগ্র অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস এবং
ঘ. সরকারের একটি ইতিবাচক ও দৃঢ় লক্ষ্যাভিমুখী ভূমিকা।
এখন দেখা জরুরি যে, উল্লিখিত কর্মকৌশলের সুনির্দিষ্ট উপাদান ইসলামী বিশ্ববীক্ষণ ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিভাবে লক্ষ্য অর্জনের পথে সম্পদ বরাদ্দ ও বণ্টনকে প্রভাবিত করতে সাহায্য করে।
(ক) পরিশোধন পদ্ধতি
সম্পদের উপর সীমাহীন চাহিদার তুলনায় সম্পদের আপেক্ষিক স্বল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশোধন কৌশলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সম্পদের উপর যত দাবি আছে, তা একটি বিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে। এতে দ্বৈত লক্ষ্য অর্জিত হবে, লভ্য সম্পদ ও চাহিদাকে সমপর্যায়ে আনা যাবে এবং ঈপ্সিত আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জিত হবে।
পুঁজিবাদ ভোক্তাদেরকে তাদের নিজ নিজ অগ্রাধিকার অনুসারে সর্বোচ্চ পরিতৃপ্তির লক্ষ্যে যা চায় তাই ভোগ করার অনুমতি দেয়। এ মতবাদ ভোক্তাদের অগ্রাধিকার বিবেচনায় উৎপাদনের যে যে জিনিস ব্যবহার করে তা বাজার নির্ধারিত মূল্যে বিশোধন কৌশল হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের মূল্য নির্ধারণ সর্বোচ্চ উপযোগিতা প্রয়াসী ভোক্তা কতটুকু ভোগ করবে এবং সর্বোচ্চ মুনাফা প্রত্যাশী উৎপাদক কী উৎপাদন করবে তা নির্ধারণ করে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটি সমতা আনয়ন করে।
পটভূমিকার শর্তাবলী পূরণ না হওয়ার বিশোধন প্রক্রিয়া হিসেবে কেবলমাত্র মূল্য ব্যবস্থার ব্যবহার আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনকে ব্যর্থ করে দেয়। বাধাহীন ব্যক্তিকেন্দ্রিক অগ্রাধিকার এবং মূল্যবোধহীন প্রচারণা ও ঋণপ্রাপ্তির সহজ সুযোগ সীমাহীন চাহিদার জন্ম দেয়, অথচ একই সময়ে বড় আকারের তীর্যক উপার্জন বণ্টনের ফলে প্রয়োজন মিটানোর জন্য দুর্লভ সম্পদ স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়। এর ফলে প্রয়োজন মিটানোর জন্য লভ্য সম্পদেরই কেবল হ্রাস ঘটে না, সঞ্চয় এবং আমদানি-রপ্তানির মধ্যেও দুরত্ব বৃদ্ধি হয় এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার আরো অবনতি ঘটে। বিশোধন কৌশল হিসেবে মূল্য কৌশলের উপর নির্ভরশীলতা চাহিদা ও সরবরাহের একটি সমতা আনয়নে সহায়তা করে, তবে তা গরীবদের কষ্টের বিনিময়ে তাদের সীমিত উপকরণ দিয়ে উচ্চমূল্যে চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এভাবে তাদের কল্যাণ বিঘ্নিত হয়।
বাজারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকৃত বিশোধন কৌশলের পরিবর্তে পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হলে অবস্থা আরো খারাপ হবে। এতে ব্যবস্থাটি একনায়কত্বমূলক হবে, অথচ লক্ষ্য অর্জনে কোনো উন্নতি হবে না। আমলাতন্ত্রের হাতে সম্পদ বরাদ্দের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূত করলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দুর্বল, ধীর ও অদক্ষ হয়ে পড়বে। কারণ ভোক্তাদের অগ্রাধিকার ও উৎপাদকের উৎপাদন ব্যয় সম্পর্কে তাড়াতাড়ি তথ্য প্রাপ্তির কোনো কার্যকর পথ আমলাতন্ত্রের কাছে নেই। এমনকি আমলাতন্ত্রের কাছে সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করতে উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থা বা সমাজসম্মত মূল্যবোধও নেই। সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের কাছে একমাত্র মানদণ্ড হলো তার নিজস্ব বিবেচনাবোধ, যা সমাজসম্মত মূল্যবোধ বা বাজার পরিস্থিতির সাহায্য ছাড়া সম্পদের আপেক্ষিক দুষ্প্রাপ্যতা বা চাহিদা পূরণের আপেক্ষিক গুরুত্ব বিবেচনায় এনে সম্পদ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে পারে না। উপরন্তু, ক্ষমতার অবস্থানগুলো এদের উপস্থিতির কারণে তাদের নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারে তারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। এর ফলে সম্পদের যে বরাদ্দ ও বিতরণ হয়ে থাকে, তা না হয় দক্ষ না হয় ন্যায়ভিত্তিক। অতএব, সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা প্রয়োগ করার জন্য সর্বোত্তম কর্মকৌশল হচ্ছে, বাজারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অপসারণ না করা। বিকেন্দ্রীকৃত ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতন্ত্রায়ন ঘটে; এ প্রক্রিয়ায় ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়ই অংশগ্রহণ করতে পারে। এ ব্যবস্থায় পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে অধিকতর দক্ষতার প্রচলন ঘটে। বরং আরো ভালো হবে অন্য কোনো উপায়ে মূল্য কৌশলের পরিপূরণ করা, যাতে সম্পদের উপর অপ্রয়োজনীয় দাবি নির্ভুল না হলেও অন্তত নিম্নতম পর্যায়ে থাকবে, এসব দাবি সে ধরনের যা ভারসাম্যহীনতা ঘটায় এবং চাহিদা পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ইসলাম নৈতিক বিশোধন প্রচলনের মাধ্যমে এ কাজ করে থাকে। বিশোধনের দ্বৈত স্তরের মাধ্যমে সম্পদের বরাদ্দ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথম স্তরের বিশোধন খিলাফত ও আদলের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যক্তিগত অগ্রাধিকারের মাত্রা পরিবর্তনের মাধ্যমে উৎস মুখেই ব্যক্তিমানুষের অন্তর সচেতনতা থেকে উদ্ভূত সীমাহীন চাহিদা ও সমস্যার মোকাবিলা করে। ইসলাম প্রত্যেক মুসলিমকে সম্পদের উপর তাদের সম্ভাব্য দাবি ইসলামী মূল্যবোধের বিশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া অপরিহার্য করেছে, যাতে বাজারে প্রবেশ করার আগেই তার অনেকগুলো বাদ পড়ে যায়। এভাবে সম্পদের উপর যে দাবি ইতবাচক প্রভাব ফেলে না বা মানবকল্যাণ অর্জন থেকে অন্য খাতে প্রবাহিত করে, সেসব দাবি বাজার মূল্যে দ্বিতীয় বিশোধন স্তরে প্রকাশ পাবার আগেই উৎসমুখেই বিলুপ্ত হয়।
নৈতিক বিশোধন সম্পদের উপর দাবিকে মানবকল্যাণের একটি কাজে পরিণত করে এবং অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সম্পদের ব্যবহার অনুমোদন করে না। উদাহরণস্বরূপ, এ বিশোধন নৈতিকভাবে নিষিদ্ধ সেসব তৎপরতায় সম্পদের ব্যবস্থার অনুমোদন করে না, যেসব তৎপরতায় মানুষ, পশু বা গাছপালা বর্তমান বা ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং তাদের কল্যাণ হ্রাস পেতে পারে। এ প্রক্রিয়া একটি সাধারণ জীবনাচার কামনা করে এবং অমিতব্যয়িতা বা অযৌক্তিক প্রতিযোগিতা বা জাঁকজমকের জন্য সম্পদের ব্যবহার অনুমোদন করে না। কারণ এ ধরণের ব্যবহার কল্যাণের ক্ষেত্রে প্রকৃত পার্থক্য সৃষ্টি করে। এ প্রক্রিয়া সম্পদের ধ্বংস বা অপব্যয়ও বরদাশত করে না (যেমন: মূল্যবৃদ্ধির লক্ষ্যে খাদ্যদ্রব্য পুডিয়ে ফেলা)। যদি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেও এমনভাবে পুনর্গঠন করা যায় যে, তা বিশোধন প্রক্রিয়ার পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে পারে, তাহলে সম্পদের উপর দাবিকে যথার্থ সীমার মধ্যে রাখা যাবে। সম্পদ, দক্ষতা ও আর্থিক মধ্যস্থতা সম্পদ বরাদ্দ ও বিতরণের ক্ষেত্রে যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এ নৈতিক প্রক্রিয়াটি সত্যকে এভাবে নমনীয় ও মানবতাসম্পন্ন করে। ব্যারিংটন মূর যথার্থই উল্লেখ করেছেন, কোনো মানবসমাজই সব ধরনের মানবিক আচরণ অনুমোদন করতে পারে না, যদি তা করত তবে শিগগিরই সমাজ হিসেবে তা অবলুপ্ত হতো’। যাইহোক, প্রত্যেকটি সমাজের অন্যতম মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের একটি নৈতিক বিশোধন কে দিতে পারবে? একটি নৈতিক পদ্ধতি কি অবশ্যই । ঐশ্বরিক সূত্র ভিত্তিক হবে এবং এর পিছনে কি অবশ্যই স্রষ্টার নিকট জবাবদিহিতার বিশ্বাস কাজ করবে? অন্যান্য কয়েকটি ধর্মের মতো ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ঐশ্বরিক মঞ্জুরি এবং পরকালে বিশ্বাস উভয়ই জরুরি।
প্রথমত, ঐশ্বরিক বিধিনিষেধের কারণে আচরণবিধি নিরঙ্কুশ ও বিতর্কের উর্ধ্বে থাকবে। স্রষ্টার বিধিনিষেধ ছাড়া প্রণীত আচরণ ব্যক্তিগত বিচারে মতভেদের বিষয় হয়ে পড়ে। যেমনটি ঘটেছে পশ্চিমা সমাজে সেকুলার মতবাদ গ্রহণের পর। পরে তাদের মূল্যবোধটিই সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন সভ্যতা ব্যাপক ও গভীরভাবে পর্যালোচনার পর ডুরান্ট ইতিহাস থেকে এ সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন যে, আমাদের সামনে ইতিহাসের এমন কোনো সমাজের উদাহরণ নেই, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যতিরেকে সাফল্যজনকভাবে কোনো নৈতিক জীবন পালন করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মানব সমাজে এমন কে আছে, যে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এবং সকলের কল্যাণে পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে পারে? যদি মানবসত্তার নিজেদেরকেই এসব নিয়ম তৈরি করতে হতো, তাহলে তা প্রণয়ন করতে তাদের মাঝে এ ধরনের প্রবণতাই কাজ করত, যাতে তা প্রতিপত্তিশালী ও বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের অনুকূলে যায় এবং যা সকলের কল্যাণ করতে অপারগ। এমনকি নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহই সর্বসম্মতির সুযোগ নস্যাৎ করে দেয়।
তৃতীয়ত, অন্যদের উপর তাদের কাজের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে সম্পর্কে মূল্যায়ন করার জ্ঞান মানুষের নেই, বিশেষ করে অনেক দূর থেকে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতএব, তাদের আচরণবিধি প্রণয়নের জন্য এমন জ্ঞানী ও বিবেকবান সত্তার প্রয়োজন, যা এ ধরনের প্রতিফল সম্পর্কে কল্পনা করতে পারে, যাতে তাদের কোনো কার্যক্রমের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অন্যেরা রক্ষা পায়।
চতুর্থত, সেই পরম সত্তা যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এককভাবে মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন, শক্তি, দুর্বলতা সম্পর্কে বুঝতে সক্ষম এবং তাদের একমাত্র নিয়ন্ত্রক ও সকল মূল্যবোধের উৎস হিসেবে দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা রাখেন। তার সীমাহীন দয়াময়তায় তিনি মানুষকে অন্ধকারের মধ্যে পথহীন ছেড়ে দেননি; স্বয়ং আদম (আ) থেকে শুরু করে নবীদের এক নিরবচ্ছিন্ন দলের মাধ্যমে তিনি তাদেরকে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ দিয়েছেন যে পথনির্দেশ সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে।
এ যৌক্তিক কাঠামোর মধ্যে মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা অকল্পনীয়। মূল্যবোধ কাঠামোর নিরপেক্ষতা কেবলমাত্র সেই ব্যবস্থার সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং আত্মস্বার্থ বা আত্মকেন্দ্রিক যুক্তিবাদিতাকে মহিমান্বিত করে। নিঃসন্দেহে এটি ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলামে প্রধানত সামাজিক দায়িত্ব ও সকলের কল্যাণের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মূল্যবোধ সকল খলিফার দায়িত্ব নির্ধারণ করে দেয়। তাদের সকলকে ‘মাকাসিদ’ বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য এ মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে হয়। সামষ্টিক মূল্যবোধ বিবেচনা অপরিহার্য এবং এ মূল্যবোধ বিচার থেকে বিরত থাকার যে কোনো প্রচেষ্টা বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে এবং সকলের কল্যাণ অর্জন ব্যর্থ করে দিতে বাধ্য। সমাজসম্মত মূল্যবোধের বিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পদের উপর দাবি বিবেচিত হবার পর এভাবে অপ্রয়োজনীয় দাবি পরিত্যাগ করে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আনতে হলে বাজার মূল্যের এ বিশোধন কৌশল দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক সম্পদ বরাদ্দ ব্যবস্থা প্রচলনে আরো বেশি কার্যকর হবে।
(খ) সঠিক প্রণোদনা
দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা কেবলমাত্র একটি যথার্থ বিশোধন কৌশলের মাধ্যমে অর্জন করা যায় না। প্রত্যেক মানুষকে সেভাবে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করাও প্রয়োজন। পুঁজিবাদের ধারণা হলোঃ আত্মস্বার্থ একজন মানুষকে তার দক্ষতাকে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবে এবং সাথে সাথে প্রতিযোগিতা আত্মস্বার্থ উদ্ধারের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে এবং সামাজিক স্বার্থ রক্ষায় সাহায্য করবে। এ্যাডাম স্মিথ তাই মনে করেন, বাজারব্যবস্থা আত্মস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হবে। সমাজতন্ত্র ব্যক্তি মানুষকে বিশ্বাস করেনি এবং এ ধারণা পোষণ করেছে যে, তার স্বীয়স্বার্থ উদ্ধারের প্রেচেষ্টা অবশ্যই সামাজিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অতএব, সামাজিক স্বার্থ রক্ষাকল্পে সম্পদ বরাদ্দ ও বিতরণের উপর এতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রহিত এবং কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কিন্তু ব্যক্তি মানুষ কর্তৃক স্বীয়স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা অনিবার্যভাবেই খারাপ নয়। মানব উন্নয়নের জন্য অবশ্যই এটি প্রয়োজন এবং অনুমোদিত না হলে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই দক্ষতা অর্জনে সফল হবে না। আত্মস্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা কেবলমাত্র তখনই ধ্বংসাত্মক হতে পারে, যখন তা কতিপয় সীমারেখা অতিক্রম করে এবং ব্যক্তি মানুষ তেমন একটি সমাজ সৃষ্টিতে আগ্রহী হয় না, যে সমাজের মূল্য ভ্রাতৃত্ব ও আর্থ সামাজিক ন্যায়বিচার। যাইহোক, বিবেকবান মানুষ কোনো সমাজে তার কাজের যথার্থ প্রতিদান পেতে সক্ষম হলে সাধারণত তার নিজের স্বার্থের জন্য তার সাধ্যমতো কাজ করতে আগ্রহী হয়। তখন প্রশ্ন ওঠে, সমাজের স্বার্থে কাজ করতে কী জিনিস তাকে উদ্বুদ্ধ করে? একজন ভোক্তা কেন সম্পদের উপর তার দাবি ‘মানবতার সীমারেখার মধ্যে’ সীমাবদ্ধ রাখবে এবং অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে এবং কেন একজন ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারবে না এবং প্রশ্নসাপেক্ষ পথে নিজে ধনী হবে না? এখানেই প্রভুর সম্মুখে জবাবদিহিতা এবং পরকালের বিশ্বাস অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। আত্মস্বার্থ অর্জনের লক্ষ্য যখন ইহকালের চিন্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তা লোভ, বিবেকহীনতা এবং অন্যের স্বার্থের প্রতি অবজ্ঞা সৃষ্টি করতে বাধ্য। দি ইকনমিষ্ট এর ভাষায় ‘যখনই তারা কোনো সুযোগ পায় বিবেকহীন অর্থনৈতিক শক্তিগুলো অন্য সবার ক্ষতির বিনিময়ে নিজেরা সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে। সুতরাং বিভিন্ন প্রকারের বাড়তির কারণে যে শক্তি সাধারণত বাজারকে কার্যকর রাখে, তাই বাজার সমাধানকে ব্যর্থ করে দেয়’। সেকুলার তথা ইহলৌকিক সমাজে সচেতনভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালনে আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক ব্যক্তি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না, যেখানে তা তাদের ইহলৌকিক কোনো সুবিধা বয়ে আনে না। পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে এ ধরনের সমাজে প্যারেটার সর্বাধিক অনুকূল অবস্থার ধারণাটি একমাত্র যৌক্তিক আচরণ পদ্ধতি। অন্যান্য সেকুলার পন্থীদের মতো ইহলৌকিক কাঠামোর মধ্যে প্যারেটোর চিন্তাচেতনা ভুল ছিল না।
কোনো ব্যক্তিকে সমাজের স্বার্থে কাজ করানোর জন্য উদ্বুদ্ধকরণের কোনো কার্যকর কৌশল পুঁজিবাদের নেই, যদি সেই স্বার্থ আত্মস্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্জিত না হয়। এ দুই স্বার্থ যখন এক নয় ও পটভূমিকার শর্তাবলীও পূরণ করে না, তখন একমাত্র মূল্যব্যবস্থার উপর নির্ভরতার ফলে ধনীরা তাদের গৌণ চাহিদা পূরণের জন্য দুষ্প্রাপ্য সম্পদ অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে; ফলে গরীবরা প্রয়োজন মেটানোর জন্য বঞ্চিত হয়। পুঁজিবাদ এভাবে অসাম্যে পরিণত হয়। সমাজতন্ত্র এর চেয়েও খারাপ। কারণ ব্যক্তি মানুষকে তার নিজের স্বার্থ উদ্ধার থেকে নিবৃত্ত করতে যেয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে কোনো ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধকরণের কর্মকৌশল এ মতবাদে নেই। এছাড়া এর ইহলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সমাজের স্বার্থে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধকরণও এই মতবাদে কোনো ব্যক্তির জন্য নেই। এভাবে সমাজতন্ত্র দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
যাইহোক, যদি সর্বশক্তিমান সত্তা, যার নিকটি থেকে কোনো কিছু লুকানো সম্ভব নয় (কোরআন-৫:৩), তাঁর সামনে জবাবদিহিতা এবং মৃত্যুর পরে জীবনের ধারণা প্রচলিত হয়, তবে উচ্চস্তরের যুক্তিবাদিতা সৃষ্টি হয়। এসব বিশ্বাস সমাজমুখী কার্যক্রম গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ শক্তি হিসেবে কাজ করে এবং তখন আত্মস্বার্থ এক সীমাহীন দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে পরিণত হয়। এসবের অর্থ হচ্ছে, কোনো ব্যক্তির নিজ স্বার্থ শুধু ইহলৌকিক অবস্থার উন্নতিতেই নিহিত নয়, তার জন্য পরলৌকিক অবস্থার উন্নতিও দরকার। অতএব সে যদি বিবেকসম্পন্ন হয় এবং নিজের জন্য যা সর্বোত্তম তাই চায়, তাহলে সে শুধু নিজের স্বল্পমেয়াদী দুনিয়ার কল্যাণের লক্ষ্যেইকাজ করবে না, দেদার ব্যয় করার আর্থিক সংগতি সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক উপভোগ হ্রাসের মাধ্যমে অন্যের কল্যাণে কাজ করে নিজের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণও নিশ্চিত করবে। এভাবে সাশ্রয়কৃত সম্পদ বর্ধিত উৎপাদন ও চাহিদা পূরণকারী মালামাল সরবরাহে ব্যবহৃত হতে পারে এবং এভাবে গরীবের স্বার্থ রক্ষিত হতে পারে। অনুরূপভাবে, পরকালের জীবনের তুলনায় ইহলোকের জীবন খুবই নগণ্য-এ বিশ্বাস কোনো ব্যবসায়ীকে প্রশ্নসাপেক্ষ উপায়ে ধনী হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে এবং এভাবে অন্যদেরকে তাদের সুযোগ সংকুচিত না করে এবং স্বাধীন জীবিকা থেকে বঞ্চিত না করে সাহয্য করতে পারে। কী, কেমন করে এবং কার জন্য উৎপাদন করতে হবে সেসব প্রশ্নের উত্তরে কোনো ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধকরণে একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কৌশল হিসেবে কাজ করতে এসব বিশ্বাস শক্তি রাখে এবং এভাবে তা সাধারণের কল্যাণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিতরণ ও বরাদ্দ নিশ্চিত করে।
ইসলাম মানুষের কাজের একটি দীর্ঘমেয়াদী জীবনদর্শন প্রদান করে, সে সঙ্গে মানুষ এ দুনিয়াতে তার আত্মস্বার্থ অস্বীকার করুক তাও চায় না। এটা বাস্তবসম্মত হতো না। যে মূল্যবোধ এরূপ ব্যবস্থা করে তা ক্রিয়াশীল হয় না। মূলত ইসলাম চায়, কোনো ব্যক্তি তার সকল অপরিহার্য প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য পূরণ করুক এবং তার নিজের ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনে দক্ষ হোক এবং তা করতে যেয়ে তার সামগ্রিক কর্মক্ষমতাকে উন্নত করুক। আল্লাহ যেসব ভালো জিনিস দান করেছেন তা পরিহার করার কোনো যুক্তি নেই (কোরআন-৭:৩২)। তবে, যেহেতু সম্পদ সীমিত, সেহেতু আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে অন্যান্য সবার কল্যাণ অগ্রাহ্য করে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক মানুষ হবার মতো চরম পর্যায়ে যাওয়া তাকে মানায় না। এলেক নোভ যথার্থই মন্তব্য করেছেন: ‘যেসব সমাজ কেবল লাভ নিয়েই ব্যস্ত, সেগুলো খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে। আক্ষরিক ও আলংকারিক অর্থে দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে, যেখানে সাফল্যের প্রধান মানদণ্ড টাকা বানানোই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে, জোসেফ স্কামপিটার মন্তব্য করেছেন যে, ‘কোনো সমাজব্যবস্থাই কাজ করতে পারে না, যেখানে প্রত্যেকেই নিজের একক স্বল্পমেয়াদী স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো কিছু দ্বারা পরিচালিত হয় না’। একটি নিক্তি (কোরআনের মিজান পরিভাষায় ৫:৭-৯) একান্তই প্রয়োজন, যা সামাজিক কল্যাণ ও মানুষের কর্মক্ষমতার অব্যাহত উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
ইসলাম এ ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য যা করেছে, তাতে আত্মস্বার্থকে আধ্যাত্মিক এবং দীর্ঘমেয়াদী মাত্রা দিতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি অবশ্যই দুনিয়ায় তার অতি ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রতি নজন দেবে, সেই সঙ্গে চিরস্থায়ী জীবন পরকালের স্বার্থের প্রতিও লক্ষ্য রাখবে। এ দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কিছুটা স্বার্থপর হয়ত হতে হয়। অবশ্য হতেই হবে এমন নয়। কেননা পরকালের স্বার্থ অন্যদের প্রতি দায়িত্ব পালন ব্যতিরেকে অর্জিত হতে পারে না। এজন্য যে সম্পূর্ণ আত্মস্বীকৃতির পথ বেছে নিতে হবে তাও নয়। অতএব, একজন সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ সত্তার সামনে জবাবদিহিতায় বিশ্বাস এভাবে আত্মস্বার্থ নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক কল্যাণমুখী আচরণ করতে উদ্বুদ্ধকরণে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরজবরদস্তি করে এ কাজ করানো সম্ভব নয়। কারণ রাষ্ট্র কর্তৃক ধৃত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্ছিদ্র নয় এবং ঘুষ দিয়ে বা রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতা ব্যবহার করে অফিসিয়াল শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এভাবে মার্কসীয় তত্ত্বে যা অস্বীকার করা হয়েছে ইসলাম তাকে স্বীকৃতি দেয়। ইসলাম লাভ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মাধ্যমে ব্যক্তির উদ্যোগ, প্রচেষ্টা, দক্ষতা ও কর্ম অভিযানে ব্যক্তির আত্নস্বার্থের অবদানকে স্বীকার করে। অবশ্য ইসলাম লোভ, বিবেকহীনতা ও অন্যদের অধিকার ও প্রয়োজন অবজ্ঞা করার ক্ষতিরকর দিক মোকাবিলা করে, যা পুঁজিবাদী, সমাজতন্ত্রী, সেকুলার স্বল্পমেয়াদী পার্থিব চিন্তাধারার অনিবার্যভাবেই প্রসার ঘটায়। ইসলাম এভাবে ব্যক্তির নিজের গহীন চেতনায় অভ্যন্তরীণ ও স্বনিয়ন্ত্রিত কর্মকৌশল প্রবিষ্ট করার মাধ্যমে এবং সেই সাতে আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার, মানব ভ্রাতৃত্ব এবং স্রষ্টার সামনে জবাবদিহিতার বিকাশের উপর নিরস্তর গুরুত্ব আরোপ করে। বিশ্বাসের এ কাঠামো সামাজিক স্বার্থ উদ্ধারের পথ বন্ধ করতে দৃঢ় উদ্বুদ্ধকারী শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
প্রতিযোগিতা ও বাজার শক্তি বরাদ্দকারী প্রক্রিয়ার দক্ষতা অর্জনে অবদান রাখার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অপরিহার্য। কিন্তু সামাজিক লক্ষ্য অর্জন যদি নিশ্চিত করতে হয় তবে এগুলোকে অবশ্যই নৈতিক মূল্যবোধের বিশোধক কর্মকৌশলের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কাজ করতে হবে। কেবলমাত্র এ সীমাবদ্ধতার মধ্যেই প্রতিযোগতিা ‘সুস্থ’ এবং বাজার শক্তি ‘মানবিক’ হতে পারে। দুর্লভ সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক ব্যবহারের জন্য মানবসত্তার মাঝে শক্তিশালী উদ্বুদ্ধকারী প্রণোদনা সৃষ্টিতে আল্লাহর সামনে জবাবদিহিতায় বিশ্বাসের যে ক্ষমতা রয়েছে, প্রতিযোগিতা বা বাজার শক্তি অথবা কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার তা নেই। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র উভয় ব্যসস্থায় নীতি নির্ধারণে এবং নিজেদের স্বার্থপর সুবিধায় সম্পদ কাজে লাগানো, প্রভাব বিস্তারে শক্তিশালী সুবিধাবাদী শ্রেণীকে বাধাদান অথবা সমাজকল্যাণের চাহিদা অনুযায়ী ব্যয় করায় উৎসাহ প্রদানের কোনো অন্তঃকৌশল নেই। অথচ অন্য কোনো কার্যকর ধর্মীয় ব্যবস্থার মতো ইসলামী ব্যবস্থায় তাদেরকে শক্তিশালীভাবে উদ্বুদ্ধ করা হবে। যদি তারা উদ্বুদ্ধ না হয়, তাহলে তারা দীর্ঘমেয়াদী আত্মস্বার্থের বিরুদ্ধেই কাজ করবে।
(গ) আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন
বিশোধন কৌশল এবং উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থা দু’টোই ভোতা হয়ে যেতে পারে, যদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনুকূল আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের পরিপূরক না থাকে। সামাজিক পরিবেশ বিশ্বস্ততার বিধি পালনের অনুকূল হওয়া উচিত, যাতে বস্তুগত সম্পদ অর্জন ও দৃষ্টি আকর্ষণ ভোগ সম্মানের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে না পারে। অর্থনৈতিক ও আর্থিক পরিবেশ এমন হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে শুধু অর্থনৈতিক বিবেচনামুখী মানুষ জন্মগ্রহণ না করে এবং জন্মগ্রহণ করলেও যেন বেঁচে না থাকে। যদি সমাজের মূল্যবোধব্যবস্থা অর্থনীতিমুখী মানুষের মর্যাদাকে আহত করে এবং যদি অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন করে, তা এমনভাবে আরো শক্তিশালী করা হয় যে, অর্থনীতির বরাদ্দ ও বিতরণকারী শক্তিসমূহ দুর্লভ সম্পদ সেসব উদ্দেশ্য ব্যবহার সমর্থন না করে লক্ষ্য অর্জনকে ব্যর্থ করে দেয়, তবে ব্যক্তি মানুষের ভোগ, আয় ও বিনিয়োগ আচরণে উন্নততর গুণ ও অর্থ সূচিত হতে পারে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে এমনভাবে জোরদার করা যায় যে, সমাজের অবৈধ শক্তির কেন্দ্রগুলো আরো দুর্বল হয়ে পড়ে, যাতে কেউ তার সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রতিপত্তি খাটিয়ে অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে। এ ধরনের পুনর্গঠনের অভাবে সম্পদ ব্যবহারে অদক্ষতা ও বৈষম্যই শুধু চিরস্থায়ী হবে না, তা দীর্ঘমেয়াদী ভারসাম্যহীনতার আরো অবনতি ঘটাবে।
এ ধরনের পুনর্গঠন এলোপাতাড়ি অস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে করা যাবে না। তা হতে হবে অবশ্যই সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুসরণের মাধ্যমে একটি সুচিন্তিত, লক্ষ্যাশ্রয়ী ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার কর্মসূচি। পুনর্গঠন কর্মসূচিতে যা বিবেচনায় আনতে হবে তা হলো:
ক. ব্যক্তি-মানুষকে তার দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ ও সহায়তার মাধ্যমে মানব উপাদানকে জোরদার করার লক্ষ্যে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা অর্জনে সহায়ত।
খ. সম্পদ ও অপ্রয়োজনীয় ভোগ নিম্নতম পর্যায়ে নিয়ে আসায় সহায়তা করা এবং চাহিদা পূরণ, রপ্তানি এবং বর্ধিত কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে ইসলামী শিক্ষার আলোকে সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং সেই সঙ্গে সরকারি রাজস্ব ও আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সংস্কার করা।
অন্য কথায় যা প্রয়োজন তা হলো, মানবসত্তার সংস্কার এবং ভোগের ধরণ বিনিয়োগ, উৎপাদনের উপাদানসমূহের সার্বিক পুনর্গঠন। সম্পদের স্বল্পতা বা ভারসাম্যতা যত বড় হবে এবং মাকাসিদ ও বাস্তবতার মাঝে দূরত্ব যত বেশি হবে, পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তাও তত ব্যাপক হবে।
পুনর্গঠনের কয়েকটি মৌলিক উপাদান একজন মুসলিমের বিশ্বাসের একটি অখণ্ড রূপ। যেহেতু পরকালে তার ভাগ্য ঐ সব বিশ্বাসের বিশ্বস্ত অনুসরণের উপর নির্ভরশীল, তা করতে তার প্রণোদনা হবে খুব জোরালো। অতএব ইসলামী পরিবেশে পুনর্গঠন সেকুলার পরিবেশের চেয়ে আরো বেশি সফল হওয়া স্বাভাবিক। একবার এ ধরনের পুনর্গঠন কার্যকরভাবে করা গেলে এর থেকে লব্দ ব্যবস্থা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র অথবা কল্যাণ রাষ্ট্রের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। যাইহোক, এ বইয়ে আর্থ-সামজিক পুনর্গঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামের সকল মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠানসমূহের পর্যালোচনা সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই। এজন্যে কোরআন, সুন্নাহ ও ফিকাহ গ্রন্থাদি রয়েছে। তথাপি চারটি প্রধান পুনর্গঠন উপাদান ইসলামে রয়েছে যার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে বা ভুল বোঝা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে:
ক. আমানতকৃত সম্পদের বিবেক মোতাবেক ব্যবহার;
খ. যাকাত ও অন্যান্য দান-সাদাকার মাধ্যমে সামাজিক সাহায্য;
গ. উত্তরাধিকার এবং
ঘ. আর্থিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন।
মাকাসিদ অর্জনে একটি নীতিমালা প্রণয়নে এসবের গুরুত্ব পরবর্তী অধ্যায়ে সুস্পষ্ট হবে।
(ঘ) রাষ্ট্রের ভূমিকা
অর্থনীতিতে রাষ্ট্র সক্রিয় ভূমিকা পালন না করলে এত ব্যাপক একটি পুনর্গঠণ সম্ভব নাও হতে পারে। রাষ্ট্রকে অবশ্যই ইসলামের মূল্যবোধ ও লক্ষ্যসমূহের বাস্তব রূপদানের চেষ্টা করতে হবে। এর কারণ হচ্ছে, এমনকি একটি নৈতিকতা সমৃদ্ধ পরিবেশেও কোনো লোক এ ধরনের হওয়া সম্ভব, যে অন্যদের অতি জরুরি প্রয়োজন সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন অথবা দুস্প্রাপ্য সমস্যা এবং সম্পদ ব্যবহারের সামাজিক অগ্রাধিকার সম্পর্কে উদাসীন। তছাড়া, এমন অনেক কাজ আছে যা সাধারণ কল্যাণের স্বার্থে সম্পাদিত হওয়া প্রয়োজন, অথচ কোনো ব্যক্তি তা করতে আগ্রহী নাও হতে পারে অথবা বাজারের ব্যর্থতা বা পর্যাপ্ত সম্পদ সংগ্রতে অপরাগতার কারণে এককবাবে বা সমষ্টিগতভাবে তা করতে সক্ষম নাও হতে পারে। এমতাবস্থায়, নৈতিক উন্নতি বা মূল্যব্যবস্থা, তা যত অপরিহার্যই হোক না কেন, সম্পদ বিতরণ ও বরাদ্দে ন্যায়পরায়ণতা ও দক্ষতার জন্য যে ধরনের পুনর্গঠন প্রয়োজন তা অর্জনে পর্যাপ্ত হতে পারে না। অতএব প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তাধারায় অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কয়েকটি বিষয়ের আওতায় এটি আলোচিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আল-আহকাম-আল সুলতানিয়া (সরকারি বিধিবিধান), মাকাসিদ আল-শরীয়াহ, আল-সিয়াসাহ আল-শরীয়াহ (শরীয়াহর রাজনৈতিক নীতি) এবং আল-হিসবাহ (সরকারি হিসাব)।
যাইহোক, ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ‘হস্তক্ষেপ’ প্রকৃতির নয়, যেখানে লেইজে ফেয়ার পুঁজিবাদের গন্ধ থাকে। এতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও উদ্যম নিঃশেষকারী ও স্বাধীনতা হরণকারী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রীয় বিতরণ ব্যবস্থার প্রকৃতি নেই। এটি ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণ রাষ্ট্রের মতোও নয়, যা মূল্যবোধ বিচারের প্রতি অনীহার কারণে সম্পদের উপর জোর দাবি জানায় এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। বরং এর ভূমিকা ইতিবাচক ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করে সকলের কল্যাণ অর্জনে সহায়তা করা, অর্থনৈতিক যন্ত্রযানকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। শক্তিশালী সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে বিচ্যুতি থেকে বাধা দেয়া রাষ্ট্রের একটি নৈতিক দায়িত্ব। ইসলামী মূল্যবোধ বাস্তবায়নে জনগণের প্রণোগনা যত বেশি হবে এবং মাকাসিদ অর্জন এবং সম্পদ ও দাবির মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক সমতা সৃষ্টিতে আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যত বেশি কার্যকর হবে, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের তত কম ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে রাষ্ট্রের ভূমিকা যাই হোক না কেন, তা স্বেচ্ছাচারী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়; শরীয়াহর বিধিনিষেধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ‘আলাপ আলোচনা’র (শুরা) মাধ্যমে কার্যকরী হওয়া উচিত।
এভাবে ইসলাম ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে মূল্য কৌশলের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়, তবে বাজার শক্তিকে অলঙ্ঘনীয় মনে করে না। বাজার শক্তির অন্ধ প্রয়োগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামাজিকভাবে সৃজনশীল, উৎপাদনশীল উদ্যোগকে প্রতিদান দেয় না, শোষণ নিয়ন্ত্রণ করে না অথবা দুর্বল ও অভাবীদেরকে সাহায্য করে না। অতএব, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে মাকাসিদ অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রকে তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য শক্তি ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন নেই বা অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করা বা তার মালিকানার উপর নির্ভর করারও প্রয়োজন নেই। শরীয়াহ বাস্তবায়নে জ্ঞান, দৃঢ় প্রত্যয় ও কৌশলের অনুসরণ প্রয়োজন (কোরআন-২:২৫৬; ও ১৬:১২৫)। রাষ্ট্র বরং সামাজিক কল্যাণের সীমারেখার মধ্যে কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য বেসরকারি খাতকে সাহায্য ও উদ্বুদ্ধকরণের চেষ্টা করবে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে জনগণের নৈতিক সচেতনতার উপর নির্ভর করতে হবে, যাতে সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার ত্বরান্বিত হয়। এ জন্য সুযোগ ও সুবিধা প্রদান করতে হবে। রাষ্ট্রকে তার লক্ষ্য অর্জনে মানবসত্তার মধ্যে যথাযথ আন্তঃসংযোগ, মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য একটি যথাযথ কাঠামো সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরবর্তী অধ্যায়ে এ ভূমিকা আরো সুস্পষ্ট হবে এবং সেখানে ইসলামী মূল্যবোধের নীতিনির্ধারণের মর্মার্থ আলোচিত হবে।
একটি ব্যাপকভিত্তিক প্রস্তাবনা
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, দক্ষ ও ন্যায়ভিত্তিক সম্পদ বরাদ্দ ও বিতরণের জন্য ইসলাম কোনো যাদুকরী ফর্মুলা, কর্মকৌশল ও প্রক্রিয়ার দাবি করে না। কোনো প্রক্রিয়ার এরকম দাবি সে সমাজের জটিলতা উপলদ্ধি ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জন এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থকে সমন্বিত করার ক্ষেত্রে অসুবিধাসমূহ উপলদ্ধির অসামর্থ্যের ইঙ্গিত দেয়। তাতে ঐ সব পদ্ধতিতে তাদের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়া, এবং সুবিধাবাদী শ্রেণীর সমৃদ্ধির জন্য ‘বৈজ্ঞানিক’ যৌক্তিকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
ইসলাম অধিকতর বাস্তবভিত্তিক। ইসলাম দুষ্পাপ্যতা থেকে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অসুবিধাসমূহ অনুভব করে এবং বিভিন্ন পন্থার সমন্বয়ে প্রণীত কর্মকৌশলের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে, যে কর্মকৌশল সম্পূর্ণভাবে ইসলামের বিশ্বদর্শন ও মাকাসিদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এ ধরনের একটি ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতিতে কার্যকর কোনো কর্মকৌশলের জন্ম হতে পারে না, সেটা হতে পারে সামাজিক শ্রেণীসমূহ ও বহুত্ববাদী দলগুলোর পরস্পর বিরোধী দাবির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে প্রণীত অসংলগ্ন নীতিসমূহের একটি জগাখিচুড়ি সংমিশ্রণ।
এরপরও কিছু লেখক এ ধরনের একটি মিথ্যা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, ইসলামী কর্মসূচী তিনটি ব্যবস্থার উপর ভিত্তিশীল-আচরণ, যাকাত ও সুদের নিষিদ্ধতা। এ তিনটি ব্যবস্থা অর্থনৈতিক কাঠামো পুণর্বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও তা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমস্ত অংশ নয়। এমনকি এ তিনটি ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভর করে যদি এর পিছনে একটি যথার্থ বিশোধনমূলক কর্মপন্থা, একটি জোরদার উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থা, কার্যকর পুনর্গঠন এবং সরকারের জন্য একটি ইতিবাচক ভূমিকার সাহায্য ও সমর্থন থাকে। এ তিনটি ব্যবস্থা এককভাবে ‘মাকাসিদ’ অর্জনের বোঝা ও দায়িত্ব বহন করতে পারে না। এটি একটি কঙ্কালের মাথার খুলি, বুক ও পা দেখে সেটিকেই মানুষ বলার মতো। এগুলো মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এগুলোর কোনোটিই একজন মানুষের ভূমিকা পালন করতে পারে না। এতে একক কোনো উপাদানের সাহায্যে সম্পূর্ণ রন্ধন প্রণালীর পার্থক্য থেকে যায়। পৃথকভাবে উপাদানগুলো সম্পূর্ণ খাবারের স্বাদ, সুগন্ধ রং ও অসম্পূর্ণতা দিতে পারে না, তা সমস্ত রন্ধন প্রণালীতে উপাদানগুলো যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন।
ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে যে, মানবসত্তার পরিবর্তনে এবং সামাজিকভাবে দায়িত্বপূর্ণতার সাথে কাজ করতে তাদেরকে উদ্বুদ্ধকরণে বিশ্বাস ও আচরণের যে ক্ষমতা রয়েছে, তাকে খাটো করে দেখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মূলত এ ধরনের বিশ্বাস ও আচরণ না থাকলে কোনো ব্যবস্থাই টিকে থাকতে পারে না, তা তার পিছনে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান যে শক্তিই থাকুক না কেন। এ ধরনের বিশ্বাস ও আচরণের আদর্শ, এমনকি পুঁজিবাদও, সমাজতন্ত্রের অধীনে টিকে থাকতে পারে না। সেকুলার মতবাদ তাকে নির্মূল করতে পারেনি, কেবল ব্যাপকভাবে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছে। গুরুত্ব না দেয়া সত্ত্বেও তারা সংক্ষিপ্ত পরিধিতে হলেও ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থেল সমন্বয় সাধনে এবং সম্পদ বরাদ্দ ও বণ্টনে ন্যায়পরায়ণতার ন্যূনতম পর্যায় সংরক্ষণের কাজ করে থাকে। এটা ব্যতিরেকে সংশ্লিষ্ট সমাজগুলো হয় নিজেদেরই টুকরো টুকরো করে ফেলবে অথবা বিপ্লবের আবর্তে নিয়োজিত হবে। তবে এগুলোর চরম অবস্থায় অধিকাংশ ব্যতিরেকে সমাজকল্যাণের মধ্যে তাদের স্বার্থ সেই পর্যায়ে সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, যে পর্যায়ে আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পুনর্গঠনের মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্যামুয়েল বৃটান যথার্থই বলেছেন, ‘কঠোর উন্নাসিকের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে, মানব ক্রিয়ায় নৈতিক বৈধতার ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করা। আত্মস্বার্থ উদ্ধারের উপর নিয়ন্ত্রণকারী কিছু বিধি ছাড়া কোনো মানব সংগঠনই কাজ করতে পারে না’। যাকাত, উত্তরাধিকার এবং সুদের উচ্ছেদ শুধুমাত্র এমন মূল্যবোধ নয়, যা প্রত্যেক মুসলিমকে ব্যক্তিগত, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণের জন্য বিশ্বস্ততার সঙ্গে মেনে চলতে হবে। মাকাসিদ অর্জন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে এসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রয়েছে। সরকারের ভূমিকাসহ ইসলামী কর্মকৌশলের অন্যান্য উপাদানসমূহের কার্যকর পুনরুজ্জীবনের পরিপ্রেক্ষিত এদের গুরুত্ব অবমূল্যায়ন করা সঠিক নয়। তবে এগুলো সবই একটি সার্বিক আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের অংশ এবং বিচ্ছিন্নভাবে প্রয়োগ করে তাদের পূর্ণ কার্যক্ষমতা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ইসলামী কর্মসূচিকে তার সার্বিক কার্যকারিতার জন্য সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করতে হবে, আংশিক গ্রহণ বাস্তবায়ন লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করতে পারে না। এ ব্যাপারে আল-কোরআনে জোর দিয়ে বলা হয়েছে:
‘তুমি কি পবিত্র গ্রন্থের একটি মাত্র বিশ্বাস করবে এবং অবশিষ্ট পরিত্যাগ করবে? কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে, তাদের জন্যে এ দুনিয়াতে বেইজ্জতি এবং হাশরের দিন কঠোর শাস্তি ছাড়া আর কি শাস্তি হতে পারে?’ (২:৮৫)
‘হে মুসলিমগণ, ইসলামের ভিতর পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কারণ সে তোমার নিশ্চিত শত্রু’। (২:২০৮)
‘আল্লাহ ততক্ষণ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’। (১৩:১১)