ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতি
ইসলামী বিপ্লবের জন্যে সমাজ জীবনের আমূল পরিবর্তন এবং তা সম্পূর্ণ নতুনভাবে পরিগঠন করার সঠিক কর্মনীতি কি? এবার আমি সংক্ষিপ্তাকারে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত বর্ণনার মাধ্যমে তা আপনাদের সামনে ব্যাখ্যা করতে চাই। তাছাড়া এই সংগ্রামকে সফলতার শিখরে পৌঁছে দেবার যথার্থ কর্মপন্থাই বা কি? তাও পরিষ্কার করতে চাই।
ইসলাম হলো সেই মহান আন্দোলনের নাম, যা মানব জীবনের গোটা ইমারত নির্মাণ করতে চায় এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। সেই অতি প্রাচীন কাল থেকেই এই আন্দোলন এই একই ভিত্তি ও পন্থায় চলে আসছে। আল্লাহর রাসূলগণই (প্রতিনিধিগণ) ছিলেন এ আন্দোলনের নেতা। তাই আমাদেরকেও যদি এ আন্দোলন করতে হয়, তবে তা অবশ্যি এই সকল নেতৃবৃন্দের পদ্ধতিতেই করতে হবে। কারণ, এছাড়া এ বিশেষ ধরণের আন্দোলনের জন্যে অন্য কেনো কর্মনীতি নেই এবং হতে পারেনা।
এ প্রসঙ্গে আম্বিয়া কেরামের (আঃ) পদচিহ্ন অনুসন্ধান শুরু করলেই আমাদেরকে একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাহলো, প্রাচীনকাল থেকে যেসব আম্বিয়ায়ে কিরাম অতীত হয়েছেন, তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত কিছুই জানতে পারিনা। কুরআনের সংক্ষিপ্ত ইশারা ইঙগিত থেকে তাঁদের কার্যক্রম সম্পর্কে সামান্য ধারণা লাভ করা যায় বটে, কিন্তু তা দ্বারা পূর্ণাঙ্গ স্কীম তৈরি করা যেতে পারেনা। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে সাইয়্যেদুনা ঈসা আলাইহিস সালামের কিছু বাণী পাওয়া যায় (যা তাঁর বাণী বলে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়), তা থেকে ইসলামী আন্দোলনের সূচনাকাল সম্পর্কে কিছুটা ইংগিত পাওয়া যায়। জানা যায়, একেবারে প্রারম্ভিক অধ্যায়ে এ আন্দোলন কিভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং কি কি সমস্যার সম্মুখীন তাকে হতে হয়। কিন্তু আন্দোলনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো সম্পর্কে সেখানে কোনো ইংগিতই পাওয়া যায় না। কারণ, সেসব অধ্যায় ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনে আসেনি।
এ ব্যাপারে আমরা কেবল এক জায়গা থেকেই পূর্ণাঙ্গ ও সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা পাই। তাহলো, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের যিন্দেগী। নিছক ভক্তি ও ভালবাসার কারণেই আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করছিনে, বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষেই এ আন্দোলনের যাবতীয় চড়াই উৎরাই ও বাঁধা বিপত্তির জগদ্দলে ভরা দীর্ঘ পথ কিভাবে পাড়ি দিতে হবে, তা জানার জন্যে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে আমরা বাধ্য। ইসলামী আন্দোলনের সকল নেতার মধ্যে কেবলমাত্র মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহই (সা.) সেই একক নেতা, যাঁর জীবনে আমরা এই ইসলামী আন্দোলনের প্রারম্ভিক দাওয়াতী আধ্যায় থেকে নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রের ধরণ, শাসনতন্ত্র, অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র বিষয়ক পলিসি এবং আইন শৃংখলা ও প্রতিরক্ষা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি অধ্যায় ও বিভাগ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সুপ্রমাণিত বিস্তারিত তথ্যাবলী পাই। সুতরাং, আমি এই একমাত্র উৎসটি থেকেই যথাযথ কর্মনীতির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করছি।
ক. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার আহ্বান
আপনাদের জানা আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে আদিষ্ট হন, তখন সারা বিশ্বে নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসংখ্য সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন ছিলো। তখন বর্তমান ছিলো রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যবাদ। শ্রেণী বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছিলো। অবৈধ অর্থনৈতিক ফায়দা (Economic exploitation) লোটার প্রতিযোগিতা চলছিলো। আর সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ করেছিলো নৈতিক অপরাধের জাল। স্বয়ং নবী করিমের (সা.) স্বদেশে ছিলো অসংখ্য জটিল সমস্যা। এসব জটিল সমস্যার সমাধানের জন্যে দেশ ছিলো একজন সুযোগ্য লীডারের অপেক্ষায় উদগ্রীব।
তাঁর গোটা দেশ ও জাতি ছিলো অজ্ঞতা, নৈতিক অধঃপতন, দারিদ্র ও দীনতা এবং ব্যভিচার ও পারস্পারিক কলহ বিবাদে চরমভাবে নিমজ্জিত। কুয়েত থেকে ইয়ামেন পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণের গোটা উপসাগরীয় এলাকা এবং উর্বর শস্য শ্যামল ইরাক প্রদেশ পারস্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রেখেছিলো জবর দখল করে। উত্তর দিকে রোম শাসকরা হিজাযের সীমানা পর্যন্ত বিস্তার করে রেখেছিলো তাদের সাম্রাজ্যবাদী থাবা। ইহুদী পূঁজিপতিরা স্বয়ং হিজাযের অর্থনীতিকেই করছিল নিয়ন্ত্রন। গোটা আরবের লোকদের তারা আবদ্ধ করে রেখেছিলো চক্রবৃদ্ধি সুদের অক্টোপাসে। তাদের শোষণ নিপীড়ন পৌঁছে গিয়েছিল চরম সীমানায়। পশ্চিম উপকূলের সোজা অপর পাড়ে হাবশায় প্রতিষ্ঠিত ছিল খ্রীস্টান রাষ্ট্র। মাত্র কয়েক বছর পূর্বে এরাই আক্রমণ চালিয়েছিলো মক্কায়। হিজায এবং ইয়ামেনের মধ্যবর্তী প্রদেশ নাজরানে বাস করতো এই খ্রীস্টানদেরই স্বজাতির লোকেরা। তাছাড়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তারা ছিলো জোটবদ্ধ। এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশেই অবস্থান করছিল তখনকার আরবদেশ, নবীর স্বদেশ।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্যে যে মহান নেতাকে নিযুক্ত করেন, তিনি গোটা বিশ্বের, এমনকি স্বদেশের এতোসব জটিল সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যার প্রতিও মনোনিবেশ করেননি। সকল সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি কেবল একটি কথার দিকেই মানুষকে আহ্বান জানালেনঃ اَنِ اعْبُدُوا اَلله وَاجْتَنبوا الطَّاغُوتِ
“হে মানুষ, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর সকল প্রভুত্ব শক্তিকে অস্বীকার করো, পরিত্যাগ করো এবং কেবলমাত্র আলাহর দাসত্ব ও আনুগত্য মেনে নাও।”
এর অর্থ এই নয় যে, তাঁর দৃষ্টিতে এই একটি ছাড়া অন্য সকল সমস্যার কোনো গুরুত্বই ছিলোনা, কিংবা সেগুলো কোনো গুরুত্ব পাবারই উপযুক্ত ছিলোনা। আপনারা জানেন, পরবর্তীকালে তিনি এ সবগুলো সমস্যার সমাধান করেন। পূর্ণ নজর দেন। একটি একটি করে সবগুলো সমস্যার সমাধান দেন। প্রাথমিক অবস্থায় এসব সমস্যা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে শুধুমাত্র একটি বিষয়ের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেয়া এবং তার সমাধানেই সকল শক্তি নিয়োগ করার পেছনে ছিল বাস্তব কারণ। এর মধ্যেই নিহিত ছিলো সকল সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি।
ইসলামী আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের নৈতিক ও সামাজিক জীবনে যতো অধঃপতনই সৃষ্টি হোক না কেন, সেগুলোর আসল কারণ হলো, মানুষের নিজেকে স্বাধীন স্বোচ্ছাচারী (Independent) এবং দায়িত্বহীন (Irresponsible) মনে করা। অন্য কথায়, নিজেকেই নিজের ইলাহ বানিয়ে নেয়া। কিংবা এর কারণ হলো, মানুষ কর্তৃক বিশ্ব জাহানের একমাত্র ইলাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকেও হুকুমকর্তা ও সার্বভৌম সত্তা হিসাবে মেনে নেয়া। চাই সে মানুষ হোক কিংবা অন্য কিছু। ইসলামের দৃষ্টিতে এই বুনিয়াদী ভুলকে তার অবস্থানের উপর বহাল রেখে কোনো প্রকার বাহ্যিক সংশোধন দ্বারা ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক অধঃপতন ও বিপর্যয় দূর করার ব্যাপারে কিছুতেই সফলতা লাভ করা যেতে পারেনা। এমতাবস্থায় এক স্থানে কোনো একটি অপরাধ করা হলেও অন্য জায়গা দিয়ে তা মাথা গজিয়ে উঠবে।
সুতরাং কার্যকর সংশোধনের সূচনা কেবল একটি পন্থায়ই করা যেতে পারে। আর তাহলো, মানুষের মন মগজ থেকে স্বাধীন স্বেচ্ছাচারিতার ধারণা নির্মূল করে দিতে হবে। তার মগজে একথা বসিয়ে দিতে হবে যে, তুমি যে জগতে বাস করছো, তা কোনো সম্রাট বা শাসকবিহীন সাম্রাজ্য নয়। নিঃসন্দেহে এ জগতের একজন বাদশাহ রয়েছেন। তাঁর কর্তৃত্ব কারো স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী নয়। তাঁর কর্তৃত্ব মিটিয়ে দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর সাম্রাজ্য থেকে অন্য কোথাও বেরিয়ে যাবার শক্তি তোমার নেই। তাঁর এই শাশ্বত ও অলংঘণীয় কর্তৃত্বের অধীনে তোমার অবস্থান করে নিজেকে স্বাধীন স্বেচ্ছাচারি মনে করাটা তোমার পক্ষে এক বিরাট বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বোকামী ও নিবুর্দ্ধিতার পরিণতি তোমাকেই ভোগ করতে হবে। তুমি যদি বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী হয়ে থাকো, তবে বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তববাদীতার (Realism) দাবী হলো, সেই মহান সম্রাটের হুকুমের সামনে মাথা নত করে দাও। তাঁর একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত দাস হয়ে জীবন যাপন করো।
তছাড়া এই বাস্তব জিনিসটিও ভালোভাবে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তাহলো, এই গোটা বিশ্বজগতের কেবলমাত্র একজনই সম্রাট, একজনই মালিক এবং একজনই স্বাধীন সার্বভৌম কর্তা রয়েছেন। এখানে অপর কারো কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকার নেই। আর বাস্তবেও এখানে অপর কারো কর্তৃত্ব চলেনা। সুতরাং তুমি তাঁর ছাড়া কারো দাস হয়ো না। অপর কারো কর্তৃত্ব স্বীকার করো না। অপর কারো সামনে মাথা নত করো না। এখানে “হিজ হাইনেস” কেউ নেই। সকল ‘হাইনেস’ শুধুমাত্র সেই সত্তার জন্যেই নির্দিষ্ট। এখানে “হিজ হোলিনেস” কেউ নেই। সমস্ত ‘হোলিনেস’ কেবলমাত্র সেই একমাত্র শক্তির জন্যেই নির্ধারিত। এখানে “হিজ লর্ডশীপ” কেউ নেই। পূর্ণাঙ্গ ‘লর্ডশীপ’ কেবল সেই একমাত্র সত্তার। এখানে বিধানকর্তা কেউ নেই। অাইন ও বিধানকর্তা কেবলমাত্র তিনি এবং কেবলমাত্র তাঁরই হওয়া উচিৎ। এখানে অন্য কোনো সরকার নেই। অন্নদাতা নেই। অলী ও কর্মকর্তা নেই। নেই কেউ ফরিয়াদ শুনার যোগ্য। ক্ষমতার চাবিকাঠি কারো কাছে নেই। কারো কোনো প্রকার শ্রেষ্ঠত্ব এবং মর্যাদা নেই। জমীন থেকে আসমান পর্যন্ত সবাই এবং সবকিছু কেবল তাঁরই দাসানুদাস।
সমস্ত মালিকানা, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কেবলমাত্র আলাহ রাব্বুল আলামীনের। তিনিই একমাত্র ‘রব’ এবং ‘মাওলা’। সুতরাং, তুমি সকল প্রকার গোলামী, আনুগত্য ও শৃংখলকে অস্বীকার করো। কেবলমাত্র তাঁরই গোলাম, অনুগত এবং হুকুমের অধীন হয়ে যাও। এটাই হচ্ছে সকল প্রকার সংস্কার সংশোধনের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তির উপরই ব্যক্তিগত চরিত্র এবং সমাজ ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ অট্টালিকা সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে উঠে। হযরত আদম (আঃ) থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টি হবে, তা সবই একমাত্র এই বুনিয়াদী পন্থায়ই সমাধান হওয়া সম্ভব।
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি, ভূমিকা এবং প্রারম্ভিক কার্যক্রম ছাড়াই সরাসরি এই মৌলিক সংশোধনের আহ্বান জানান। এই আহ্বানের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছা পর্যন্ত তিনি কোনো প্রকার বাঁকাচোরা পথ অবলম্বন করেননি। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাজ করে মানুষের উপর কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেননি, যে প্রভাব দ্বারা লোকদের পরিচালনা করে ধীরে ধীরে স্বীয় লক্ষ্যে উপনীত হতে পারতেন। এ সবের কিছুই তিনি করেননি। বরঞ্চ আমরা দেখি, হঠাৎ আরবের বুকে এক ব্যক্তি মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই।’ তাঁর দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যেও এই মৌলিক ঘোষণার চাইতে নিম্নতর কোনো কিছুর প্রতি নিবদ্ধ হয়নি। কেবল নবীসুলভ সাহসিকতা আর আবেগ উদ্যমই এর কারণ নয়। বস্তুত এটাই ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত কর্মনীতি। এছাড়া অন্যান্য উপায়ে যে প্রভাব, কার্যকরিতা ও কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়, এই মহান সংস্কার কাজের জন্যে তা কিছুমাত্র সহায়ক নয়। যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর মৌলিক আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো কারণে আপনার সহযোগী হয়, এই মহান পুনর্গঠনের কাজে তারা আপনার কোনো উপকারে আসতে পারেনা।
এই মহান কাজে কেবল সেসব লোকই আপনার সহায়ক ও সহযোগী হতে পারে, যারা শুধুমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ আওয়াজ শুনে আপনার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ মহাসত্যকেই জীবনের বুনিয়াদ ও জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে নেয় এবং এরই ভিত্তিতে কাজ করতে প্রস্তুত হয়। সুতরাং, ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার জন্যে যে বিশেষ ধরণের চিন্তা ও কর্মকৌশল প্রয়োজন, তার দাবীই হচ্ছে, কোনো ভূমিকা ও উপক্রমণিকা ছাড়াই সরাসরি তাওহীদের এই মৌলিক দাওয়াতের মাধ্যমে কাজ আরম্ভ করতে হবে।
তাওহীদের এই ধারণা নিছক কোনো ধর্মীয় ধ্যান ধারণা নয়। বরঞ্চ এ হচ্ছে এক পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন। এ দর্শন স্বেচ্ছাচারিতা এবং গাইরুল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের উপর সমাজ জীবনে যে কাঠামো বিনির্মিত হয়েছে, এ দর্শন তাকে সম্পূর্ণ মুলোৎপাটিত করে দেয়। বিলকুল এক ভিন্ন ভিত্তি ও বুনিয়াদের উপর গড়ে তোলে নতুন অট্টালিকা।
আজ পৃথিবীর লোকেরা আপনাদের মুয়াযযিনের ‘আশ্হাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ বিপ্লবী আওয়াজকে নীরবে শুনে যায়। কারণ, ঘোষণাকারীও জানেনা সে কি ঘোষণা করছে? আর শ্রোতাদেরও নজরে পড়েনা এর কোনো অর্থ আর উদ্দেশ্য। কিন্তু ঘোষণাকারী যদি জেনে বুঝে ঘোষণা দেয় আর দুনিয়বাসীও যদি বুঝতে পারে যে, এই ঘোষণাকারী বলছেঃ আমি কাউকেও সম্রাট মানিনা, শাসক মানিনা। কোনো সরকারকে আমি স্বীকার করিনা। কোনো আইন আমি মানিনা। কোনো আদালতের আওতাভূক্ত (Jurisdiction) আমি নই। কারো নির্দেশ আমার কাছে নির্দেশ নয়। কারো প্রথা আমি স্বীকার করিনা। কারো বৈষম্যমূলক উচ্চ অধিকার, কারো রাজশক্তি, কারো অতিপবিত্রতা এবং কারো স্বেচ্ছাচারী উচ্চক্ষমতা আমি মোটেও স্বীকার করিনা। এক আল্লাহ ছাড়া আমি সকলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। সকলের থেকে আমি বিমুখ।
ঘোষক আর শ্রোতারা যদি ঘোষণার এই প্রকৃত মর্ম বুঝতে পারে, তবে কি আপনি মনে করছেন বিশ্ববাসী এই ঘোষণাকে সহজভাবে হজম করে নেবে? বরদাশত করবে নীরবে? বিশ্বাস করুন, সে অবস্থায় আপনি কারো সাথে লড়তে যান বা না যান, বিশ্ববাসী কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে। এই ঘোষণা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই আপনি অনুভব করবেন, গোটা বিশ্ব আপনার দুশমন হয়ে গেছে। চতুর্দিক থেকে সাপ, বিচ্ছু আর হিংস্র পশুরা আপনাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করছে।
খ. অগ্নি পরীক্ষায় নিখাদ প্রমাণিত হওয়া
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন এই আওয়াজ উচ্চারণ করেছিলেন, তখনো ঠিক এই একই অবস্থা ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো। ঘোষক জেনে বুঝেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। শ্রোতারাও বুঝতে পারছিলো কি কথার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে! তাই এই ঘোষণার যে দিকটি যাকে আঘাত করেছে, সেই উদ্যত হয়ে উঠেছে একে নিভিয়ে দেয়ার জন্যে। পোপ ও ঠাকুররা দেখলো এ আওয়াজ তাদের পৌরহিত্যের জন্য বিপজ্জনক। জমিদার মহাজনরা তাদের অর্থ সম্পদের, অবৈধ উপার্জনকারীরা তাদের অবৈধ উপার্জনের, গোষ্ঠী পূজারীরা গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্বের (racial supererioty), জাতি পূজারীরা জাতীয়তাবাদের পূর্বপুরুষদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পথ ও মতের। মোটকথা এ আওয়াজ শুনে সব ধরণের মূর্তি পূজারীরা নিজ নিজ মূর্তি বিচূর্ণ হবার ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠলো। তাই এতোদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধোমত্ত থাকা সত্ত্বেও এখন সকল কুফুরী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলো। ‘আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ’ এই নীতি কথাটি তারা বাস্তবে রূপ দিলো। এক নতুন আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তারা সমবেত হয়ে গেলো এক প্লাটফরমে। গঠন করলো ঐক্যজোট।
এই কঠিন অবস্থাতে মুহাম্মদ (সা.) এর সাথী কেবল তারাই হলো, যাদের ধ্যান ধারণা ও মনমগজ ছিলো পরিষ্কার ও পরিশুদ্ধ। যাদের মধ্যে যোগ্যতা ছিলো সত্যকে বুঝবার এবং গ্রহণ করবার। যাদের মধ্যে সত্যপ্রিয়তা ছিলো এতোটা প্রবল যে, সত্য উপলব্ধির পর সে জন্যে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দেবার এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবার জন্যে তারা ছিলো সদা প্রস্তুত। এই মহান আন্দোলনের জন্যে এই ধরণের লোকদেরই ছিলো প্রয়োজন। এ ধরণের লোকেরা দু’একজন করে আন্দোলনে আসতে থাকে। সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে সংঘাত।
অতঃপর কারো রুজি রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। কাউকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়। কেউ আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারো ছুটে যায় বন্ধু, কারো হিতাকাংখী। কারো উপরে আসে মারধর। কাউকেও করা হয় জিঞ্জিরাবদ্ধ। কাউকে পাথর চাপা দিয়ে শুইয়ে রাখা হয় তপ্ত বালুকার উপর। কাউকেও জর্জরিত করা হয় গালি দিয়ে, কাউকেও বা পাথর দিয়ে। উৎপাটিত করা হয় কারো চোখ। বিচূর্ণ করা হয় কারো শির। নারী, সম্পদ, ক্ষমতা, নেতৃত্ব এবং সকল প্রকার লোভনীয় জিনিস দিয়ে খরিদ করার চেষ্টাও করা হয় কাউকে। এই সকল অগ্নিপরীক্ষা ইসলামী আন্দোলনের উপরে এসেছে। আসা জরুরী ছিলো। এগুলো ছাড়া ইসলামী আন্দোলন না মজবুত হতে পারতো, আর না পারতো ক্রমবিকাশ ও প্রসার লাভ করতে।
এসব অগ্নিপরীক্ষা ইসলামী আন্দোলনের জন্যে ছিলো খুবই সহায়ক। এসব অগ্নিপরীক্ষার পয়লা ফায়দা এই ছিলো যে, এর ফলে ভীরু কাপুরুষ, হীন চরিত্র ও দূর্বল সংকল্পের লোকেরা এ আন্দোলনের কাছেই ঘেঁষতে পারেনি। তাই সমাজের মনিমুক্তগুলোই কেবল এসে শরীক হলো আন্দোলনে। আর এ মহান আন্দোলনের জন্যে প্রয়োজন ছিলো এদেরই। তাই যিনিই এই আন্দোলনে শরীক হলেন, কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়েই তাকে শরীক হতে হয়েছে। বস্তুত এক মহান বিপ্লবী আন্দোলনের উপযোগী শ্রেষ্ঠ লোকদের বাছাইর জন্যে এর চাইতে উত্তম আর কোনো পন্থা হতে পারেনা।
এই অগ্নিপরীক্ষার দ্বিতীয় ফায়দা হলো, এরকম কঠিন অবস্থার মধ্যে যারা আন্দোলনে শরীক হয়েছে, তাঁরা কোনো প্রকার ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতীয় স্বার্থে নয়, বরঞ্চ কেবলমাত্র সত্যপ্রিয়তা এবং আল্লাহ ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্যেই এই ভয়াবহ বিপদ মুসীবত ও দুঃখ লাঞ্ছনার মোকাবেলা করেছেন। এরই জন্যে তাঁদের সইতে হয়েছে শত অত্যাচার নির্যাতন। এরই জন্যে হতে হয়েছে আহত প্রহৃত। এরই জন্যে তাদের পড়তে হয়েছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের হিংস্র কোপানলে। কিন্তু এর ফল হয়েছে শুভ। এর ফলে তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকে ইসলামী আন্দোলনের উপযোগী মন মানসিকতা। পয়দা হতে থাকে খাঁটি ইসলামী চরিত্র। আল্লাহর ইবাদতে সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হতে থাকে পরম আন্তরিকতা আর নিষ্ঠা।
আসলে বিপদ মুসীবতের এই মহা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ইসলামী চরিত্র ও ভাবধারা সৃষ্টি হওয়া ছিলো এক স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো ব্যক্তি যখন একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রবল উদ্যমে যাত্রা শুরু করে, আর তার সেই লক্ষ্য পথে যদি তাকে সম্মুখীন হতে হয় প্রাণান্তকর সংগ্রাম, চরম দ্বন্দ্ব সংঘাত, অবর্ণনীয় বিপদ মুসীবত, দুঃখ কষ্ট, সীমাহীন হয়রানী, যাতনাকর আঘাত, অমানবিক কারা নির্যাতন, বিরামহীন ক্ষুধা আর দুঃসহনীয় নির্বাসনের, তবে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফলে তার সেই মহান লক্ষ্য ও আদর্শের সমস্ত বৈশিষ্ট্য প্রবলভাবে রেখাপাত করে তার হৃদয়-মনে। তার মন মগজ, শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হতে থাকে তার সেই মহান লক্ষ্যেরই ফল্গুধারা। তার গোটা ব্যক্তি সত্তাই তখন তার জীবনোদ্দেশ্যের রূপ পরিগ্রহ করে।
লক্ষ্য অর্জনের পরিপূর্ণতা সাধনের এ সময়টিতে তাদের উপর ফরয করা হয় সালাত। এর ফলে, দূর হয়ে যায় তাদের দৃষ্টির সকল সংকীর্ণতা। গোটা দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তি এসে নিবদ্ধ হয় আপন লক্ষ্যের উপর। যাঁকে তারা একচ্ছত্র সার্বভৌম শাসক বলে স্বীকার করে নিয়েছে, বার বার স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের ধ্যান ধারণা ও মন-মস্তিষ্কে বদ্ধমূল হয়ে যায় তাঁর প্রভুত্ব আর সার্বভৌমত্ব। যাঁর হুকুম ও নির্দেশনার ভিত্তিতে আঞ্জাম দিতে হবে জীবন ও জগতের সকল কাজ, তিনি যে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সবকিছুই অবহিত। তিনি যে বিচার দিনের সম্রাট। তিনি যে সকল বান্দাহর উপর দুর্দণ্ড প্রতাপশালী-এই কথাগুলো বদ্ধমূল হয়ে যায় তাদের মন ও মস্তিষ্কে। কোনো অবস্থাতেই তাঁর আনুগত্য ছাড়া অপর কারো অানুগত্যের বিন্দুমাত্র চিন্তাও তাদের অন্তরে প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় সম্পূর্ণরূপে।
এই অগ্নিপরীক্ষা ও চরম সংঘাতের তৃতীয় সুফল এই ছিলো যে, এর ফলে একদিকে এই বিপ্লবী কাফেলায় যারা শরীক হচ্ছিল, বাস্তব ময়দানে তাদের হতে থাকে যথার্থ প্রশিক্ষণ। অপরদিকে দিনের পর দিন প্রসারিত সম্প্রসারিত হতে থাকে ইসলামী আন্দোলন। মানুষ যখন দেখতে থাকলো, কিছু লোক দিনের পর দিন মার খাচ্ছে। নির্যাতিত হচ্ছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই এর আসল কারণ জানবার প্রবল আগ্রহ পয়দা হতে থাকে তাদের মনে। এই লোকগুলোকে নিয়ে কেন এতো হৈ হট্টগোল? -এই প্রশ্নের জবাব পেতে উৎসুক হয়ে উঠে তাদের মন। অতঃপর তাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টি যখন জানতে পারতো, আল্লাহর এই বান্দাগুলো কোনো নারী, সম্পদ, প্রতিপত্তি বা কোনো প্রকার ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং এক মহাসত্য তাদের কাছে উন্মুক্ত হয়েছে এবং তারা তা একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে ধরে আছে বিধায় এভাবে তাদের অত্যাচার করা হচ্ছে, তখন স্বঃতই সেই মহাসত্যকে জানার জন্যে তাদের মন হয়ে উঠতো ব্যাকুল।
অতঃপর যখন লোকেরা জানতে পারতো, সেই মহাসত্য হচ্ছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, আর এ জিনিসই মানব জীবনে এমন ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করে, এরই দাওয়াত নিয়ে এমনসব লোকেরা উত্থিত হয়েছে, যারা কেবল এই সত্যেরই জন্যে দুনিয়ার সমস্ত ফায়দা ও স্বার্থকে ভূলুন্ঠিত করছে। নিজেদের জমি, মাল, সন্তান সন্ততিসহ প্রতিটি জিনিস অকাতরে কুরবানী করছে, তখন তারা বিস্ময়ে অবিভূত হয়ে যেতো। খুলে যেতো তাদের চোখ। ফেটে যেতো তাদের মন মগজকে আচ্ছন্ন করে রাখার পর্দা। আর এই মহা সত্য তাদের হৃদয়ের মধ্যে বিদ্ধ হতো তীরের তীব্র ফলকের মতো। এরই ফলে সব মানুষ এসে শামিল হয়েছে এই আন্দোলনে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কেবল সেই গুটিকয়েক লোকই এ আন্দোলনে শরীক হতে পারেনি, যাদেরকে আভিজাত্যের অহংকার, পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ আর পার্থিব স্বার্থ সম্পূর্ণরূপে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এছাড়া সে সমাজের প্রতিটি নিঃস্বার্থ ও সত্যপ্রিয় লোককেই, কেউ আগে কেউ পরে, শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলনে এসে শরীক হতে হয়েছে।
গ. নেতা ছিলেন আদর্শের মডেল
এ সময় আন্দোলনের নেতা নিজ ব্যক্তিগত জীবনের মাধ্যমে তাঁর এই আন্দোলনের যাবতীয় মূলনীতি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সুস্পষ্টভাবে মানব সমাজের সামনে তুলে ধরেন। তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ, এবং চালচলন ও গতিবিধির মধ্যে ফুটে উঠতো ইসলামের প্রাণসত্তা। এতে লোকেরা বাস্তবভাবে বুঝতে পারতো ইসলাম কি জিনিস? এ বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনার দাবী রাখে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যাখ্যামূলক আলোচনার অবকাশ নেই। তাই অতি সংক্ষেপে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক এখানে উপস্থাপন করছি।
এই বিপ্লবী আন্দোলনের নেতার স্ত্রী হযরত খাদীজা (রা.) ছিলেন তৎকালীন আরবের সর্বাধিক অর্থশালী মহিলা। তিনি তাঁর স্ত্রীর এই অর্থ সম্পদ দিয়ে ব্যবসা করতেন। ইসলামের দাওয়াত শুরু করার পর তাঁর সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, অনুক্ষণ দাওয়াতী কাজে ব্যস্ত থাকা এবং এর ফলে গোটা আরববাসীকে নিজের শত্রু বানিয়ে নেয়ার পর ব্যবসায়ের কাজ আর কিছুতেই চলা সম্ভব ছিলোনা। নিজেদের হাতে পূর্বের যা কিছু জমা ছিলো, আন্দোলন সম্প্রসারণের কাজে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তা নিঃশেষ করে দেন। এরপর তাদেরকে এক চরম অর্থ সংকটের সম্মুখীন হতে হয়। দ্বীন প্রচারের কাজে তিনি যখন তায়েফ গমন করেন, তখন হিজাযের এক সময়কার এই বাণিজ্য সম্রাটের ভাগ্যে সোয়ারীর জন্যে একটি গাধা পর্যন্ত জোটেনি।
কুরাইশের লোকেরা তাঁকে হিজাযের রাজতখ্ত গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়। তারা বলে, আমরা আপনাকে আমাদের বাদশাহ বানিয়ে নেবো। আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে আপনার কাছে বিয়ে দেবো। সম্পদের স্তূপ আপনার পদতলে ঢেলে দেবো। এসব কিছু আমরা আপনার জন্যে করবো। করবো একটি শর্তে। তাহলো, এই আন্দোলন থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু মানবতার মুক্তিদূত তাদের এইসব লোভনীয় প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এইসবের পরিবর্তে তিনি তাদের উপহাস, তিরস্কার আর প্রস্তরাঘাতকেই সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন।
কুরাইশ এবং আরবের সমাজপতিরা বললো, হে মুহাম্মদ! আপনার দরবারতো সব সময় কৃতদাস, দরিদ্র এবং নীচু শ্রেণীর (নাউযুবিল্লাহ্) লোকেরা বসে থাকে। এমতাবস্থায় আমরা কি করে আপনার দরবারে এসে বসতে পারি? আমাদের ওখানে যারা একেবারে নীচু শ্রেণীর, তারাই সব সময় আপনার চারপাশ ঘিরে থাকে। তাদেরকে আপনার নিকট থেকে তাড়িয়ে দিন, তবেই আমরা আপনার কাছে আসতে পারি, কথাবার্তা বলতে পারি। কিন্তু গোটা মানবতার যিনি নেতা, যিনি এসেছেন মানুষের উঁচু-নীচু শ্রেণীবিভেদ মিটিয়ে দেবার জন্যে, তিনি তো কিছুতেই সমাজপতিদের মন রক্ষার জন্যে দরিদ্রদের বিতাড়িত করতে পারেন না।
এই বিপ্লবী আন্দোলনের মহান নেতা মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আন্দোলনের ব্যাপারে নিজের দেশ, জাতি, গোত্র ও বংশের কারো স্বার্থেরই কোনো পরোয়া করেননি। আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো স্বার্থের সাথেই তিনি আপোষ করেননি। তাঁর এই নৈতিক দৃঢ়তাই মানুষের মনে এক চরম আস্থার জন্ম দিলো যে, নিঃসন্দেহে মানুষের কল্যাণের জন্যে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। আর এ আস্থার ফলেই প্রত্যেকটি কওমের লোক এসে তাঁর আন্দোলনের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। তিনি যদি কেবল নিজ খান্দানের কল্যাণ চিন্তা করতেন, তবে হাশেমী গোত্রের লোক ছাড়া আর কারোই এ আন্দোলনের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকতো না। তিনি যদি কুরাইশদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যস্ত হতেন, তবে অকুরাইশ আরবরা তাঁর আন্দোলনে শরীক হবার কল্পনাই করতো না। কিংবা আরব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা যদি হতো তাঁর উদ্দেশ্য, তবে হাবশী বেলাল, রোমদেশীয় সুহাইব আর পারস্যের সালমানের (রা.) কি স্বার্থ ছিলো তাঁর সহযোগিতা করার?
বস্তুত, যে জিনিস সব জাতির লোকদের তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছে, তা ছিলো নিরেট আল্লাহর দাসত্বের আহ্বান। ব্যক্তিগত, বংশগত, গোত্রগত ও জাতিগত স্বার্থের ব্যাপারে পরিপূর্ণ অনাগ্রহ। গোটা মানবতাকে খালেস আল্লাহর দাসত্বের প্রতি আহ্বানের ফলেই বংশ, বর্ণ ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল ধরণের মানুষ এ আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রণোৎসর্গ করতে সবাই প্রস্তুত হয়ে যায়।
তিনি যখন মক্কা থেকে হিজরত করতে বাধ্য হন, তখনো তাঁর শত্রুদের প্রচুর ধন সম্পদ তাঁর কাছে আমানত ছিলো। এগুলো নিজ নিজ মালিকের কাছে ফেরৎ দেবার জন্যে তিনি হযরত আলীকে (রা.) বুঝিয়ে দিয়ে যান। কোনো দুনিয়া পূজারী লোকের পক্ষে এ ধরণের সুযোগ হাতছাড়া করা সম্ভব নয়। সে সবকিছুই আত্মস্যাৎ করে সাথে নিয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর দাস তখনো নিজের জানের দুশমন ও রক্ত পিপাসুদের সম্পদ তাদের হাতে পৌঁছে দেবার চিন্তা করেন, যখন তারা তাঁকে হত্যা করবার ফায়সালা গ্রহণ করে। নৈতিক চরিত্রের এই অকল্পনীয় উচ্চতা অবলোকন করে আরবের লোকেরা বিস্মিত না হয়ে পেরেছিলো কি? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দুই বছর পর যখন তারা বদর ময়দানে তাঁর বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করেছিল, তখণ তাদের মন হয়তো তাদের বলছিল, এ কোন্ মহা মানবের সাথে তোমরা লড়ছো? সেই মহানুভবের বিরুদ্ধে তোমরা তরবারি উত্তোলন করছো, জন্মভূমি থেকে বিদায়ের কালেও যিনি মানুষের অধিকার ও আমানতের দায়িত্বের কথা ভোলেননি? হয়তো জিদের বশবর্তী হয়ে তখন তারা তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, কিন্তু তাদের বিবেক তাদের দংশন করছিলো। আমার বিশ্বাস, বদর যুদ্ধে কাফিরদের পরাজয়ের নৈতিক কারণগুলোর মধ্যে এটাও ছিলো অন্যতম।
ঘ. আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপ্লব
তের বছরের প্রাণান্তকর সংগ্রামের পর মদীনায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে। এ সময় আন্দোলনে এমন আড়াই তিনশ লোক সংগৃহীত হয়ে যায়, যারা ইসলামের পূর্ণ প্রশিক্ষণ পেয়ে এতোটা যোগ্য হয়েছিলো যে, তারা যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতিতে মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম ছিলো। একটি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে এ লোকগুলি পুরোপুরি তৈরি করা ছিলো। সুতরাং সেই কাংখিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেয়া হলো। দশ বছর পর্যন্ত স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) এই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রদান করেন। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি তাদেরকে রাষ্ট্রের সকল বিভাগ ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালনা করার প্রশিক্ষণ দিয়ে যান। এ যুগটি ছিলো ইসলামী আদর্শের তাত্ত্বিক ধারণার (Abstract Idea) স্তর পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ সমাজ কাঠামোর স্তরে পৌঁছার যুগ। এ যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রভৃতি সকল বিষয়ে ইসলামের নীতি ও পলিসি সুস্পষ্ট রূপরেখা লাভ করে। জীবনের প্রতিটি বিভাগের মূলনীতি প্রণীত হয়। সেইসব মূলনীতিকে বাস্তবে রূপদানও করা হয়।
এই বিশেষ কর্মনীতি ও কর্মপদ্ধতিতে কাজ করার জন্যে শিক্ষা দীক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মী বাহিনী তৈরি করা হয়। এই লোকেরাই বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামী শাসনের এমন আদর্শ নমুনা পেশ করেছিলো যে, মাত্র আট বছর সময়কালের মধ্যে মদীনার মতো একটি ক্ষুদ্রায়তনের রাষ্ট্র গোটা আরব রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেখান থেকেই যে লোক ইসলামের বাস্তবরূপ দেখতে পেলো এবং এর শুভ পরিণাম অনুভব করতে পারলো, সে স্বঃতই বলে উঠলো, প্রকৃতপক্ষে এরই নাম মানবতা। এরই মধ্যে রযেছে মানবতার কল্যাণ। দীর্ঘকাল ব্যাপী যারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো, শেষ পর্যন্ত তাদেরকেও এই মহান আদর্শ গ্রহণ করতে হয়েছিলো। খালিদ বীন ওয়ালিদ ইসলামের ছায়াতলে এসে যান। আবু জাহেলের পুত্র ইকরামা ইসলাম কবুল করেন। আবু সুফিয়ান ইসলামের পক্ষে এসে যায়। হযরত হামযার (রা.) হন্তা ওহাশী ইসলামের বিধান গ্রহণ করে নেন। হযরত হামযার (রা.) কলিজা ভক্ষণকারী হিন্দাকেও শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির সত্যবাণীর সম্মুখে মাথা নত করে দিতে হয়, যার চাইতে ঘৃণিত ব্যক্তি তার দৃষ্টিতে আর কেউই ছিল না।
ঐতিহাসিকরা ভুল করেই তখনকার যুদ্ধগুলোকে বিরাট গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করেছেন। এ ভুলের কারণে লোকেরা মনে করে বসেছে, আরবের সেই মহান বিপ্লব যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। অথচ আসল ব্যাপার এর সম্পূর্ণ উল্টো। সেই আট বছরে যে যুদ্ধগুলো দ্বারা আরবের যুদ্ধবাজ কওমগুলো তিরস্কৃত হয়েছিলো, তার সবগুলোতে উভয়পক্ষের হাজার বারশ’র বেশী লোক নিহত হয়নি। পৃথিবীর বিপ্লব সমূহের ইতিহাস যদি আপনার জানা থাকে, তবে আপনাকে অবশ্যি স্বীকার করতে হবে, এ বিপ্লব রক্তপাতহীন বিপ্লব (Bloodless Revolution) নামে আখ্যায়িত হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
তাছাড়া এ বিপ্লবের ফলাফলও পৃথিবীর অন্যসব বিপ্লবের চাইতে ভিন্নধর্মী। এ বিপ্লবে কেবল রাষ্ট্র ব্যবস্থারই পরিবর্তন হয়নি। বরঞ্চ মানুষের মন মানসিকতা এবং চিন্তাভাবনাও পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো। এতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। চিন্তা পদ্ধতি বদলে যায়। জীবন যাপন পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ে যায়। নৈতিক চরিত্রের জগতে আসে আমূল পরিবর্তন। স্বভাব ও অভ্যাস যায় পাল্টে।
মোটকথা, এ মহান বিপ্লব গোটা জাতির কায়া পরিবর্তন করে দেয়। ব্যাভিচারী নারী সতীত্বের রক্ষক হয়ে যায়। মদ্যপায়ী মাদকবিরোধী আন্দোলনের পতাকাবাহী হয়ে যায়। আগে যে চুরি করতো, এ বিপ্লব তার মধ্যে আমানতদারীর অনুভূতি এতোটা তীব্রভাবে জাগ্রত করে দেয় যে, এখন সে এ ভেবে বন্ধুর বাড়ীর খানা খেতেও দ্বিধান্বিত হয়, না জানি এটাও অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ ভক্ষণ বলে গণ্য হয়ে যায়! এমনকি এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাকে কুরআনের মাধ্যমে তাদের আশ্বস্ত করতে হয়েছে যে, এ ধরণের খাবার খেতে কোনো দোষ নেই। ডাকাত ও ছিনতাইকারীরা এমন অনুপম দীনদার ও বিশ্বস্থ হয়ে গিয়েছিলো যে, ইরান বিজয়ের সময় এদেরই একজন সাধারণ সৈনিক কোটি কোটি টাকা মূল্যের রাজমুকুট হস্তগত হবার পর, তা রাতের অন্ধকারে কম্বলের নিচে লুকিয়ে সেনাপতির নিকট পৌঁছে দেয়। সে এই গোপনীয়তা এই জন্যে অবলম্বন করেছিলো, যাতে করে এই অস্বাভাবিক ঘটনা দ্বারা লোক সমাজে তার আমানতদারীর খ্যাতি ছড়িয়ে না পড়ে। তার ইখলাস বা নিয়তের নিষ্ঠার মধ্যে ‘রিয়া’ ও প্রদর্শনী মনোবৃত্তির কলঙ্ক লেগে না যায়।
যাদের কাছে মানুষের জীবনের কোনো মূল্য ছিলনা, যারা নিজ হাতে স্বীয় কন্যাদের জীবন্ত কবর দিতো, তাদের মধ্যে জীবনের নিরাপত্তা ও মর্যাদাবোধ এমন তীব্রভাবে জ্রাগ্রত হয়েছিলো যে, নির্দয়ভাবে একটি মুরগী জবাই করতে দেখলেও তাদের কাছে চরম কষ্ট লাগতো। যাদের গায়ে কখনো সত্যবাদিতা ও ন্যায় পরায়ণতার বাতাস পর্যন্ত লাগেনি, তাদের মধ্যে ন্যায় পরায়ণতা, সততা ও সত্যবাদিতার এমন উচ্চতম বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছিলো যে, খায়বরের সন্ধির পর এদের তহসীলদার ইহুদীদের কাছ থেকে সরকারী রাজস্ব আদায় করতে গেলে ইহুদীরা তাকে এই উদ্দেশ্যে একটি মোটা অংকের অর্থ দিতে চায়, যাতে করে সে সরকারী পাওনা কম করে নেয়। কিন্তু সে তাদের মুখের উপর উৎকোচ নিতে অস্বীকার করে দেয় এবং উৎপন্ন ফসল তাদের ও সরকারের মধ্যে সমান দুই স্তূপে বন্টন করে তাদেরকে যেকোনো এক স্তূপ গ্রহণ করার অধিকার প্রদান করে। মুসলিম তহসীলদারের ইনসাফ ও সততার এই চরম পরাকাষ্ঠা দেখে ইহুদীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো, আর অজ্ঞাতেই তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, ‘এই ধরণের আদল ও ইনসাফের উপরই আসমান ও জমীন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।’
তাদের মধ্যে এমন সব শাসনকর্তার আবির্ভাব ঘটে, যাদের কোনো প্রাসাদ ছিলনা। বরঞ্চ তারা জনগণের সাথে বসবাস করতেন এবং তাদের মতো সাধারণ কুটীরেই বাস করতেন। পায়ে হেঁটে হাটবাজারে যেতেন। দরজায় দ্বাররক্ষী রাখতেন না। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যে কেউ যখন ইচ্ছা তাদের সাথে সাক্ষাত করতে পারতো। তাদের মধ্যে এমন সব ন্যায়পরায়ণ বিচারপতির আবির্ভাব ঘটে, যাদেরই একজন জনৈক ইহুদীর বিরুদ্ধে স্বয়ং খলীফার দাবী একারণে খারিজ করে দেন যে, খলীফা স্বীয় গোলাম এবং পুত্র ব্যতিত আর কাউকেও সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করাতে পারেননি। তাদের মধ্যে এমন সব সেনাপতির আবির্ভাব ঘটে, যাদেরই একজন কোনো একটি শহর থেকে বিদায় নেবার প্রাক্কালে শহরবাসীদের থেকে আদায়কৃত সমস্ত জিনিস এই বলে তাদের ফেরত দিয়ে যান যে, এখন থেকে যেহেতু আমরা তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে পারবো না, সে কারণে তোমাদের থেকে আদায়কৃত কর আমাদের হাতে রাখার কোনো অধিকার আমাদের নেই।
এমনি করে তাদের মধ্যে জন্ম নেয় অসংখ্য নির্ভীক রাষ্ট্রদূত। এদেরই একজন ইরানী সেনাধ্যক্ষের ভর দরবারে ইসলাম বর্ণিত মানবিক সুবিচারপূর্ণ নীতি নির্ভীকভাবে প্রকাশ করেন। তীব্র সমালোচনা করেন ইরানী শ্রেণী বৈষম্যের। আল্লাহ জানেন, সেদিনকার এই ঘটনায় কতো ইরানী সিপাহীর অন্তরে এই মানবধর্মের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ জাগ্রত হয়েছিলো। ইসলামী বিপ্লব তাদের মধ্যে এমন সব তীব্র নৈতিক দায়িত্বানুভূতি সম্পন্ন নাগরিকের জন্ম দেয়, যাদের দ্বারা হাত কাটা এবং পাথর মেরে হত্যা করার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাবার পরও, নিজেরাই এসে নিজেদের উপর দণ্ড প্রয়োগের দাবী করতে থাকে, যাতে কারে তাদের চোর বা ব্যাভিচারী হিসেবে আল্লাহর আদালতে হাজির হতে না হয়। ইসলামী বিপ্লব এমন সব আদর্শ সিপাহীর জন্ম দেয়, যারা বেতন বা কোনো পার্থিব স্বার্থ লাভের জন্যে যুদ্ধ করেনি। বরঞ্চ কেবলমাত্র সেই মহান আদর্শের জন্যে যুদ্ধ করেছে, যার প্রতি তারা ঈমান এনেছিলো। বেতন ভাতা তো তারা গ্রহণ করেইনি। তদুপরি নিজ খরচে তারা যুদ্ধের ময়দানে যেতো এবং গণীমতের মাল হস্তগত হলে, তা সরাসরি সেনাপতির দরবারে এনে হাজির করতো। নিজে হস্তগত করতো না।
এখন বলুন, সামজিক চরিত্র ও সমষ্টিগত মানসিকতার এই আমূল পরিবর্তন কি শুধু যুদ্ধ বিগ্রহ দ্বারা সম্ভব ছিলো? ইতিহাস আপনাদের সম্মুখে রয়েছে। এমন কোনো উদাহরণ কি আপনারা তাতে পেয়েছেন যে, শুধুমাত্র তরবারি কোনো মানব গোষ্ঠীর মধ্যে এমন আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে?
মূলত এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার, যেখানে প্রথম তের বছরে মাত্র আড়াই তিনশ’ লোক সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে পরবর্তী দশ বছরে গোটা দেশ মুসলমান হয়ে গেলো। এর রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়ে লোকেরা নানা রকম অমূলক অবাস্তব ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করে থাকে। অথচ এর কারণ দিবালোকের মতো পরিষ্কার, সুস্পষ্ট।
যতোদিন এই নতুন আদর্শ অনুযায়ী মানব জীবনের বাস্তব রূপায়ণ লোকেরা দেখতে পায়নি, ততোদিন এই অভিনব আন্দোলনের নেতা আসলেই কি ধরণের সমাজ গড়তে চান, তা তারা বুঝে উঠতে পারেনি। এ সময় নানা ধরণের সন্দেহ সংশয় তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। কেউ বলতো, এতো কেবল কবির কল্পনাবিলাস। কেউ বলতো, এটাতো কেবল ভাষার জাদুগিরি। কেউ বলতো, লোকটি আসলে পাগল হয়ে গেছে। আবার কেউ তাকে নিছক একজন কল্পনাবিলাসী (Visionary) লোক বলে ঘোষণা করতো।
এসময় কেবল অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী প্রতিভাবান লোকেরাই ঈমান এনেছিলো। যারা বাস্তব দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন, এই আদর্শের মূলেই রয়েছে মানবতার কল্যাণের প্রকৃত চিহ্ন। কিন্তু যখন এই কল্পিত আদর্শের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো, লোকেরা স্বচক্ষে এর বাস্তব চিত্র দেখতে পেলো এবং তাদের চোখের সামনে এর সীমাহীন সুফল দেখতে পেলো, তখন তারা বুঝতে পারলো, আল্লাহর এই বান্দাহ এই মহান সমাজ গঠনের জন্যেইতো এতো দুঃখ কষ্ট আর অত্যাচার নির্যাতন সয়ে আসছেন। এরপর জিদ আর হঠকারিতার উপর অটল থাকার আর কোনো সুযোগই থাকলো না। যার কপালেই দুটি চোখ ছিলো, আর চোখের মধ্যে জ্যোতি ছিলো, তার পক্ষে এই চোখে দেখা বাস্তবতাকে অস্বীকার করার আর কোনো উপায়ই ছিলনা।
আসলে ইসলাম যে সমাজ বিপ্লব সংঘটিত করতে চায়, এটাই হলো তার সঠিক পন্থা। এটাই সেই বিপ্লবের রাজপথ। এই পন্থায়ই তার সূচনা হয় আর এই ক্রমধারায়ই হয় তা বিকশিত। এই বিপ্লবকে একটা মু’জিযা মনে করে লোকেরা বলে বসে, এ কাজ এখন আর সম্ভব নয়। এটাতো নবীর কাজ। নবী ছাড়া তা করা সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিহাসের অধ্যায়ন আমাদের একথা পরিষ্কার করে বলে দেয়, এ বিপ্লব এক স্বাভাবিক বিপ্লব। এর মধ্যে কার্যকারণ পরস্পরার পূর্ণ যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই। আজো যদি ঐ একই পদ্ধতিতে কাজ করি, তবে একই ধরণের ফলাফল প্রকাশ হতে পারে।
তবে, একথা সত্য, এ কাজের জন্যে প্রয়োজন ঈমান, ইসলামী চেতনা, ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মজবুত ইচ্ছাশক্তি এবং ব্যক্তিগত আবেগ উচ্ছাস ও স্বার্থের নিঃশর্ত কুরবানী। এ কাজের জন্যে এমন একদল দুঃসাহসী যুবকের প্রয়োজন, যারা সত্যের প্রতি ঈমান এনে তার উপর পাহাড়ের মতো অটল হয়ে থাকবে। অন্য কোনো দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হবেনা। পৃথিবীতে যাই ঘটুক না কেন, তারা নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পথ থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হবে না। পার্থিব জীবনে নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতির সকল সম্ভাবনাকে অকাতরে কুরবানী করে দেবে। স্বীয় সন্তান সন্ততি, পিতা মাতা ও আপনজনের স্বপ্ন সাধ বিচূর্ণ করতে কুন্ঠাবোধ করবেনা। আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবদের বিচ্ছেদ বিরাগে চিন্তিত হবেনা। সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, জাতি, স্বদেশ, যা কিছুই তাদের উদ্দেশ্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে, তারই বিরুদ্ধে লড়ে যাবে। অতীতেও এ ধরণের লোকেরাই আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করেছে। আজো কেবল এ ধরণের লোকেরাই আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করতে পারে। এ মহান বিপ্লব কেবল এ ধরণের লোকের দ্বারাই মংঘটিত হতে পারে। (তর্জমানুল কুরআন, সেপ্টেম্বরঃ ১৯৪০ ইং)।
সংযোজন
উপরোক্ত নিবন্ধে ইসলামী বিপ্লবের কর্মপন্থা সম্পর্কে যে স্পষ্ট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করা হলো, যদিও বিষয়টি অবহিত হবার জন্যে তাই যথেষ্ট, তারপরও এ সম্পর্কে হযরত মসীহ আলাইহিস সালামের কিছু বক্তব্য বিশেষ পরস্পরার সাথে এখানে উল্লেখ করা উপযোগী মনে করছি। তাঁর এ বক্তব্যগুলোতে ইসলামী আন্দোলনের প্রাথমিক অধ্যায়ের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সাইয়্যেদুনা মসীহ আলাইহিস সালাম যে পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে ফিলিস্তিনবাসীদের কাছে ‘হুকুমাতে ইলাহিয়ার’ দাওয়াত পেশ করেছিলেন, যেহেতু তার সাথে আমাদের বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির মিল রয়েছে, সে জন্যে তাঁর কর্মপন্থার মধ্যে আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ পাওয়া যেতে পারে।
“একজন আলেম জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মূসার দেওয়া হুকুমের মধ্যে সবচেয়ে দরকারী হুকুম কোনটা’? উত্তরে ঈসা বলিলেন, সবচেয়ে দরকারী হুকুম এই, ‘ইস্রায়েলীয়রা শুন, প্রভু, যিনি আমাদের খোদা, তিনি এক; আর তোমার সমস্ত অন্তর, তোমার সমস্ত প্রাণ, তোমার সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়া, প্রভু, যিনি তোমার খোদা, তাঁহাকে মহাব্বত করিবে।’ তখন সেই আলেম বলিলেন, ‘হুজুর খুব ভাল কথা। আপনি সত্য কথাই বলিয়াছেন, খোদা এক এবং তিনি ছাড়া আর কোনো খোদা নাই।’ ” (মার্ক/১২:২৮-৩২)
“প্রভু, যিনি তোমার খোদা, তাঁহাকেই তুমি সিজদা করিবে, কেবল তাহারই সেবা করিবে।” (লুক/৪:৮)
“এই জন্যে তোমরা এইভাবে মুনাজাত করিও, আমাদের বেহেশতি পিতা, তোমার নাম পবিত্র বলিয়া মান্য হোক। তোমার রাজ্য আসুক। তোমার ইচ্ছা যেমন বেহেস্তে, তেমনি দুনিয়াতেও পূর্ণ হোক।” (মথি/৬:৯-১০)
শেষ বাক্যটিতে হযরত মসীহ (আঃ) তাঁর উদ্দেশ্যের কথা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। সাধারণভাবে খোদার বাদশাহী বলতে কেবল তাঁর আধ্যাত্মিক বাদশাহীর যে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার লাভ করেছে, এ বাক্য তা পুরোপুরিভাবে খন্ডন করে দিয়েছে। পৃথিবীতে খোদার আইন ও শরয়ী বিধানের তেমনি প্রতিষ্ঠাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো, যেমনি সমগ্র সৃষ্টির উপর তাঁর প্রাকৃতিক আইন কার্যকর রয়েছে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই তিনি লোকদের তৈরি করছিলেন।
“আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে আসিয়াছি, এই কথা মনে করিওনা; আমি শান্তি দিতে আসি নাই। বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাইতে আসিয়াছি; ছেলেকে পিতার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বউকে শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাইতে আসিয়াছি। নিজের পরিবারের লোকেরাই মানুষের শত্রু হইবে।”
“যে কেহ আমার চাইতে পিতা মাতাকে বেশী মহব্বত করে, সে আমার উপযুক্ত নয়। আর যে কেহ ছেলে বা মেয়েকে আমার চেয়ে বেশী মহব্বত করে, সে আমার উপযুক্ত নয়। যে নিজের ক্রুশ লইয়া আমার পথে না চলে, সেও আমার উপযুক্ত নয়। যে কেহ নিজের জীবন রক্ষা করিতে চায়, সে তাহার সত্যিকারের জীবন হারাইবে; কিন্তু যে কেহ আমার জন্যে তাহার জীবন কোরবানী করিতে রাজী থাকে, সে তাহার সত্যিকারের জীবন রক্ষা করিবে।” (মথি/১০:৩৪-৩৯)
“যদি কেহ আমার পথে আসিতে চায়, তবে সে নিজের ইচ্ছামতো না চলুক; নিজের ক্রুশ বহন করিয়া আমার পিছে আসুক।” (মথি/১৬:২৪)
“ভাই ভাইকে এবং পিতা ছেলেকে মারিয়া ফেলিবার জন্যে ধরাইয়া দিবে। ছেলে মেয়েরা পিতা মাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া তাহাদের খুন করাইবে। আমার জন্যে সকলে তোমাদের ঘৃণা করিবে, কিন্তু যে শেষ পর্যন্ত স্থির থাকিবে, সে উদ্ধার পাইবে।” (মথি/১০:২১-২২)
“দেখ, আমি নেকড়ে বাঘের মধ্যে ভেড়ার মতো তোমাদের পাঠাইতেছি। সাবধান থাকিও, কারণ মানুষ বিচার সভার লোকদের হাতে তোমাদের ধরাইয়া দিবে এবং তাহাদের মজলিশ খানায় তোমাদের বেত মারিবে। আমার জন্যই শাসনকর্তা ও রাজাদের সামনে তোমাদের লইয়া যাওয়া হইবে।” (মথি/১০:১৬-১৮)
“যে আমার নিকট আসিবে, সে যেন নিজের পিতা মাতা, স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে, ভাইবোন, এমনকি নিজেকে পর্যন্ত যেন আমার চেয়ে কম প্রিয় মনে করে। তাহা না হইলে সে আমার উম্মত হইতে পারে না। যে লোক নিজের ক্রুশ বহন করিয়া আমার পিছনে না আসে, সে আমার উম্মত হইতে পারেনা।”
“আপনাদের মধ্যে যদি কেহ একটা উচু ঘর তৈরি করিতে চায়, তবে সে আগে বসিয়া খরচের হিসাব করে। সে দেখিতে চায় যে, উহা শেষ করিবার জন্য তাহার যথেষ্ট টাকা আছে কি-না। তাহা না হইলে, সে ভিত্তি গাঁথিবার পরে যদি সে উচু ঘরটা শেষ করিতে না পারে, তবে যাহারা উহা দেখিবে তাহারা সকলে তাহাকে ঠাট্টা করিবে। তাহারা বলিবে, ‘লোকটা গাঁথিতে আরম্ভ করিয়াছিল কিন্তু শেষ করিতে পারিলনা।’ সেইভাবে আপনাদের মধ্যে যদি কেহ ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার সমস্ত কিছু ছাড়িয়া না আসে, তবে সে আমার উম্মত হইতে পারে না।” (লুক/১৪:২৬-৩০)
এ সবগুলো আয়াত এ কথাই প্রমাণ করে যে, মসীহ (আঃ) কেবল একটি ধর্ম প্রচারের জন্যেই আবির্ভূত হননি, বরঞ্চ গোটা সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করাই ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য। তাই, গোটা রোম সাম্রাজ্য, ইহুদী রাষ্ট্র এবং ফকীহ ও ফরীশীদের নেতৃত্ব, এক কথায় সকল আত্মপূজারী ও স্বার্থন্বেষীদের সাথে তাঁর সংঘাত সংঘর্ষের সমূহ আশংকা ছিলো বিদ্যমান। তাই তিনি সুস্পষ্টভাবে সবাইকে বলে দিচ্ছিলেন, আমি যে কাজ করতে যাচ্ছি তা সাংঘাতিক বিপজ্জনক। আমার সাথে কেবল তাদেরই আসা উচিত, যারা এ সকল বিপদ মুসীবত বরদাশত করতে প্রস্তুত হবে।
“তোমাদের সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করে, তাহার বিরুদ্ধে কিছুই করিও না। বরং যে কেহ তোমার ডান গালে চড় মারে, তাহাকে অন্য গালেও চড় মারিতে দিও। যে কেহ তোমার কোর্তা লইবার জন্যে মামলা করিতে চায়, তাহাকে তোমার চাদরও লইতে দিও। যে কেহ তোমাকে তাহার বোঝা লইয়া এক মাইল যাইতে বাধ্য করে, তাহার সঙ্গে দুই মাইল যাইও।” (মথি/৫:৩৯-৪১)
“যাহারা কেবল দেহ ধ্বংস করে, কিন্তু রূহকে ধ্বংস করতে পারে না, তাহাদের ভয় করিও না। যিনি দেহ ও রূহ দুইটিই দোযখে ধ্বংস করিতে পারেন, বরং তাহাকেই ভয় করো।” (মথি/১০:২৮)
“এই দুনিয়াতে তোমরা নিজেদের জন্যে ধন সম্পদ জমা করিও না। এখানে মরিচায় ধরে ও পোকায় নষ্ট করে এবং চোর ঢুকিয়া চুরি করে। বরং বেহেশতে তোমাদের ধন জমা করো।” (মথি/৬:১৯-২০)
“কেহ দুই মনিবের সেবা করিতে পারে না। খোদা এবং ধন সম্পত্তি এই দুইয়েরই এক সঙ্গে সেবা করিতে পার না। কি খাইবে বলিয়া বাঁচিয়া থাকিবার বিষয়ে, কিংবা কি পরিবে বলিয়া দেহের বিষয়ে চিন্তা করিও না। বনের পাখিদের দিকে তাকাইয়া দেখ; তাহারা বীজ বুনেনা, ফসল কাটেনা, গোলাঘরে জমাও করেনা, আর তবু তোমাদের বেহেশতি পিতা তাহাদের খাওয়াইয়া থাকেন। তোমরা কি তাহাদের চেয়ে আরও মূল্যবান নও? তোমাদের মধ্যে কে চিন্তা ভাবনা করিয়া নিজের আয়ু এক ঘন্টা বাড়াইতে পারে? কাপড় চোপড়ের জন্য কেন চিন্তা করো? মাঠের ফুলগুলির কথা ভাবিয়া দেখ, সেইগুলি কেমন করিয়া বাড়িয়া উঠে। তাহারা পরিশ্রম করেনা, সুতাও কাটেনা। কিন্তু তোমাদের বলিতেছি, সোলায়মান রাজা এতো জাঁকজমকের মধ্যে থাকিয়াও এইগুলির একটার মতোও নিজেকে সাজাইতে পারেন নাই। মাঠের যে ঘাস আজ আছে, আর আগামী কাল চুলায় ফেলিয়া দেওয়া হইবে, তাহা যখন খোদা এইভাবে সাজান; তখন ওহে অল্প বিশ্বাসীরা, তিনি যে তোমাদের নিশ্চয়ই সাজাইবেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তোমরা প্রথমে খোদার রাজ্যের বিষয়ে এবং তাহার ইচ্ছামতো চলিবার জন্যে ব্যস্ত হও। তাহা হইলে ঐ সমস্ত জিনিসও তোমরা পাইবে।” (মথি/১৬:২৪-৩৩)
“চাও, তোমাদের দেওয়া হইবে; খোঁজ কর, পাইবে; দরজায় আঘাত কর, তোমাদের জন্যে খোলা হইবে।” (মথি/৭:৭) সাইয়্যেদুনা ঈসা (আঃ) বৈরাগ্যবাদ, ত্যাগ এবং আজন্ম কৌমার্যের শিক্ষাদান করেছেন বলে সাধারণে ভ্রান্ত ধারণা গড়ে উঠেছে। অথচ! এই বিপ্লবের সূচনাকালে লোকদের ধৈর্য্য, কষ্ট সহিষ্ণুতা এবং আল্লাহ নির্ভরতার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান ছাড়া কোনো গত্যন্তরই ছিলনা। যেখানে একটি রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা পূর্ণ শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং মানবজীবনের সমস্ত উপায় উপকরণ কব্জা করে রেখেছে, সেখানে কোনো একটি দল পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব সাধণের জন্যে অগ্রসর হতে পারেনা, যতোক্ষণ না সে মন মগজ থেকে জানমালের মহব্বত দূরে নিক্ষেপ করবে, দুঃখ কষ্ট ও বিপদাপদ বরদাশত করার জন্যে প্রস্তুত হবে, বহু পার্থিব লাভ কোরবানী করতে এবং অসংখ্য পার্থিব ক্ষতি স্বীকার করতে তৈরি হয়ে যাবে।
প্রকৃতপক্ষে সমকালীন প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অর্থই হলো, সমস্ত বিপদ মুসীবতকে নিজেদের উপর ডেকে আনা। এ মহান কাজের জন্যে যারা উত্থিত হবে, তাদেরকে এক থাপ্পড় খেয়ে আরেক থাপ্পড়ের জন্যে অবশ্যি প্রস্তুত থাকতে পবে। জামা হাতছাড়া হলে চোগা হারাবার জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হবে। সমকালীন জীবিকার ভান্ডার যাদের মুষ্টিবদ্ধে, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আবার তাদের থেকে অন্ন বস্ত্র লাভ করার আশা করা যেতে পারে না। তাই কেবল সেই ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম, যে এসব উপায় উপকরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে, কেবল এক আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে।
“তোমরা যাহারা ক্লান্ত ও বোঝা বহিয়া বেড়াইতেছ, তোমরা সকলে আমার নিকট আস; আমি তোমাদের বিশ্রাম দিব। কারণ আমার জোয়াল বহন করা সহজ ও আমার বোঝা হাল্কা।” (মথি/১১:২৮-৩০)
সম্ভবত এর চাইতে সংক্ষেপে এবং মর্মস্পর্শী ভাষায় হুকুমাতে ইলাহীয়ার মেনিফেস্টো সংকলন করা যেতে পারে না। মানুষের উপর মানুষের জোয়াল অত্যন্ত কঠিন এবং ভারী। এ বোঝার তলায় পিষ্ট মানুষকে হুকুমাতে ইলাহীয়ার নকীব যে সংবাদ শুনাতে পারেন, তা হলো, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার জোয়াল আমি তোমাদের উপর রাখতে চাই, তা যেমনি কোমল তেমনি হাল্কা।
“অইহুদীদের মধ্যে রাজারা প্রভুত্ব করেন। আর তাহাদের শাসনকর্তাদের বলা হয় উপকারী নেতা, কিন্তু তোমাদের মধ্যে এই রকম হওয়া উচিত নয়। তোমাদের যে সবচেয়ে বড়, সে বরং সবচেয়ে যে ছোট তাহারই মত হোক, আর যে নেতা সে সেবাকারীর মতো হোক।” (লুক/২২:২৫-২৬)
মসীহ আলাইহিস সালাম তাঁর সাথীদেরকেই (হাওয়ারী) এসব উপদেশ দিতেন। এ বিষয়ে ইঞ্জিলগুলোতে বেশ কিছু বাণী বর্তমান রয়েছে। সেগুলোর সারকথা হলো, ফেরাউন এবং নমরূদদের হটিয়ে তোমরা নিজেরাই আবার ফেরাউন নমরূদ হয়ে বসো না।
“মূসার শরীয়ত শিক্ষা দিবার ব্যাপারে আলেমরা ও ফরীশীরা মূসার জায়গায় আছেন। এই জন্য তাহারা যাহা কিছু করিতে বলেন, তাহা করিও এবং যাহা পালন করিবার আদেশ করেন, তাহা পালন করিও। কিন্তু তাহারা যাহা করেন, তোমরা তাহা করিও না। কারণ তাহারা মুখে যাহা বলেন, কাজে তাহা করেন না। তাহারা ভারী ভারী বোঝা বাঁধিয়া মানুষের কাঁধে চাপাইয়া দেন, কিন্তু সেইগুলি সরাইবার জন্য নিজেরা একটা আঙ্গুল নাড়াইতেও চান না। লোকদের দেখাইবার জন্যেই তাহারা সমস্ত কাজ করেন। পাক কিতাবের আয়াত লেখা তাবিজ তাহার বড় করিয়া তৈরি করেন। আর নিজেদের ধার্মিক দেখাইবার জন্য চাদরের কোণায় কোণায় লম্বা ঝালর লাগান। ভোজের সময়ে সম্মানের জায়গায় এবং মজলিশখানায় প্রধান আসনে তাহারা বসিতে ভালবাসেন। তাহারা হাটে বাজারে সম্মান খুঁজিয়া বেড়ান আর চান, যেন লোকেরা তাহাদের ওস্তাদ (রাব্বী) বলিয়া ডাকে।”
“ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ধিক আপনাদের! আপনারা! লোকদের সামনে বেহেশতি দরজা বন্ধ করিয়া রাখেন। তাহাতে নিজেরাও ঢুকেন না, আর যাহারা ঢুকিতে চেষ্টা করিতেছে, তাহাদেরও ঢুকিতে দেন না।”
“ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ধিক আপনাদের! একটি মাত্র লোককে আপনাদের ধর্মমতে আনিবার জন্যে আপনারা দুনিয়ার কোথায় না যান। আর সে যখন আপনাদের ধর্মমতে আসে, তখন আপনারা নিজেদের চেয়ে তাহাকে অনেক বেশী করিয়া তোলেন।”
“আপনারা নিজেরা অন্ধ অথচ অন্যদের পথ দেখান। একটা ছোট মাছিও আপনারা ছাঁকেন অথচ উট গিলিয়া ফেলেন।”
“ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ধিক আপনাদের! আপনারা চুন লাগানো সাদা কবরের মতো, যাহার বাহিরের দিকটা সুন্দর, কিন্তু ভিতরে মরা মানুষের হাড় গোড় ও সমস্ত রকম ময়লায় ভরা। ঠিক সেইভাবে বাহিরে বাহিরে আপনারা লোকদের চোখে ধার্মিক, কিন্তু ভিতরে ভণ্ডামী ও পাপে পূর্ণ।” (মথি/২৩:২-২৮)
সে সময়কার আলেম ও শরীয়তের ধারক বাহকদের এ ছিলো অবস্থা। ইলমের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবল আত্মপূজার কারণে তারা ছিলো গুমরাহ, পথভ্রষ্ট। সাধারণ লোকদেরও তারা ভ্রান্তপথে পরিচালিত করছিলো, আর এই বিপবের পথে রোমের কাইজারদের থেকেও তারা বড় প্রতিবন্ধক ছিলো।
“তখন ফরীশীরা চলিয়া গেলেন এবং কেমন করিয়া ঈসাকে তাঁহার কথার ফাঁদে ফেলা যায়, সেই পরামর্শ করিতে লাগিলেন। তাহারা হেরোদের দলের কয়েকজন লোকের সঙ্গে নিজেদের কয়েকজন সাগরেদকে ঈসার নিকট পাঠাইলেন। তাহার ঈসাকে বলিল, ‘হুজুর, আমরা জানি, আপনি একজন সৎলোক। খোদার পথের বিষয়ে আপনি সত্যভাবে শিক্ষা দিয়া থাকেন। লোকে কি মনে করিবে না করিবে, তাহাতে আপনার কিছু যায় আসে না। কারণ, আপনি কাহারও মুখ চাহিয়া কিছু করেন না। তাহা হইলে আপনি বলুন, রোম সম্রাটকে কি কর দেওয়া হালাল? আপনার কি মনে হয়? তাহাদের খারাপ উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া ঈসা বলিলেন, ‘ভণ্ডেরা, কেন আমাকে পরীক্ষা করিতেছ? যে টাকায় কর দিবে তাহার একটা আমাকে দেখাও।’ তাহারা একটা দীনার ঈসার নিকট আনিল। তখন ঈসা তাহাদের বলিলেন, ‘ইহার উপর এই ছবি ও নাম কাহার?’ তাহার বলিল, ‘রোম সম্রাটের’। ঈসা তাহাদের বলিলেন, ‘তবে যাহা সম্রাটের তাহা সম্রাটকে দাও, আর যাহা খোদার তাহা খোদাকে দাও।’ (মথি/২২:১৫-২১)
এ ঘটনা থেকে জানা যায়, মূলত এটা ছিলো একটা ষড়যন্ত্র। ফরীশীরা আন্দোলন পাকা হবার অাগেই সরকারের সাথে হযরত ঈসার (আঃ) সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দিতে এবং আন্দোলন শিকড় গেড়ে বসার আগেই সরকারী শক্তি দ্বারা তাকে মূলোৎপাটিত করে দিতে চাইছিলো। সে কারণে হেরোদী রাষ্ট্রের সিআইডিদের সামনে রোম সম্রাটকে কর দেয়া বৈধ কিনা, সে প্রশ্ন তারা উত্থাপন করেছিল। জবাবে হযরত ঈসা (আঃ) যে নিগূঢ় অর্থবহ কথাটি বলেছিলেন, বিগত দু’হাজার বছর থেকে খ্রীষ্টান অখ্রীষ্টান সকলে তার এই অর্থই করে আসছে যে, ইবাদত কর খোদার আর অনুগত্য কর সমকালীন প্রতিষ্ঠিত সরকারের। কিন্তু আসলে তিনি একথাও বলেননি যে, রোম সম্রাটকে কর দেয়া বৈধ। কারণ এমনটা বলা ছিলো তাঁর দাওয়াতের পরিপন্থী। আর তাকে ট্যাক্স না দেয়ার কথাও তিনি বলেননি। কারণ তখন পর্যন্ত তাঁর আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে, তিনি কর প্রদান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন। এ জন্যেই তিনি তখন একটি সূক্ষ্ম কথা বলে দিলেন যে, কাইজারের নাম এবং ছবি তাকে ফেরত দাও। আর খোদা যে নিখাঁদ সোনা তৈরি করেছেন, তা তার পথে ব্যয় করো।
তাদের এ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবার পর তারা স্বয়ং মসীহ আলাইহিস সালামের জনৈক সাহাবীকে ঘুষ দিয়ে এমন এক সময় মসীহ আলাইহিস সালামকে গ্রেফতার করিয়ে দিতে সম্মত করায়, যখন গণবিদ্রোহের কোনো আশংকা থাকবে না। তাদের এ ষড়যন্ত্র সফল হয়। ইহুদী সক্রীটু হযরত মসীহকে গ্রেফতার করিয়ে দেয়।
“তখন সেই সভার সকলে উঠিয়া ঈসাকে প্রধান শাসনকর্তা পীলাতের নিকট লইয়া গেলেন। তাহারা এই কথা বলিয়া ঈসার বিরুদ্ধে নালিশ জানাইতে লাগিলেন, ‘আমরা দেখিয়াছি, এই লোকটা সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের লোকদের লইয়া যাইতেছে। সে সম্রাটকে কর দিতে নিষেধ করে এবং বলে, সে নিজেই মসীহ, একজন রাজা।’ ”
“তখন পীলাত প্রধান ইমামদের এবং সমস্ত লোকদের বলিলেন, ‘আমিতো এই লোকটির কোন দোষই দেখিতে পাইতেছি না।’ কিন্তু তাহারা জিদ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এহুদিয়া প্রদেশের সমস্ত জায়গায় শিক্ষা দিয়া সে এ লোকদের ক্ষেপাইয়া তুলিতেছে। গালীল প্রদেশ হইতে সে শুরু করিয়াছে, আর এখন এখানে আসিয়াছে।’ ”
“কিন্তু লোকেরা ঈসাকে ক্রুশের উপর মারিয়া ফেলিবার জন্যে চিৎকার করিতে থাকিল এবং শেষে তাহার চেঁচাইয়া জয়ী হইলো।” (লুক/২৩: ১-২৩)
এভাবেই ঐ সমস্ত লোকদের হাতে মসীহ আলাইহিস সালামের মিশনের পরিসমাপ্তি ঘটে, যারা নিজেদেরকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের উত্তরাধিকারী মনে করতো। ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণ অনুযায়ী মসীহ আলাইহিস সালামের নবুয়্যতকাল ছিলো দেড় থেকে তিন বছরের মতো। এ সংক্ষিপ্ত সময়কালে তিনি ঐ পরিমাণ কাজ করেছিলেন, যতোটা করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর মক্কী জীবনের প্রাথমিক দুই তিন বছরে। কোনো ব্যক্তি যদি ইঞ্জিলের উপরোল্লিখিত আয়াতগুলোর সাথে কুরআন মজীদের মক্কী সূরাসমূহ এবং মক্কায় অবস্থানকালীন হাদীসগুলোকে মিলিয়ে দেখেন, তবে তিনি এতদোভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামঞ্জস্য দেখতে পাবেন।
— সমাপ্ত —-