বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
স্বাভাবিক নিয়মে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার কর্মপন্থা আমি সুস্পষ্টভাবে এ প্রবন্ধে তুলে ধরতে চাই। আমি দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রের নাম শিশুদের খেলনায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন পন্থা ও শ্রেণীর লোকেরা ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা ও তা প্রতিষ্ঠার খেয়াল ব্যক্ত করছেন। কিন্তু এই লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্যে এমন সব অদ্ভুত পথ ও পন্থার প্রস্তাব তারা করছেন, যেসব পথ ও পন্থায় এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সেরকমই অসম্ভব, মটর গাড়ীতে করে আমেরিকায় পৌঁছা যেরকমই অসম্ভব। এরকম অসার কল্পনার (Loose thinking) কারণ হলো, কোন না কোন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে তাদের অন্তরে এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার খায়েশ পয়দা হয়ে গেছে, যার না হবে “ইসলামী রাষ্ট্র”। কিন্তু এই রাষ্ট্রটির ধরণ ও বৈশিষ্ট্য কি হবে, নিরেট বৈজ্ঞানিক (Scientific) পন্থায় তারা তা জানার চেষ্টা করেনি। আর এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিতই বা হয় কোন্ পন্থায়, তাও জানবার কোশেশ তারা করেনি। এমতাবস্থায়, বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন অনুভব করছি।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিবর্তন
যে কোনো ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থাই যে কৃত্রিম পন্থায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা, সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুমাত্র জ্ঞান রাখেন, এমন সবাই তা জানেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থা এক জায়গা থেকে তৈরি করে এনে অন্য জায়গায় স্থাপন করার মতোও কোনো বস্তু নয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা তো কোনো একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তাচেতনা, মন মানসিকতা, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্ম প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে জন্ম লাভ করে। এর জন্যে কিছুটা প্রাথমিক উপায় উপাদান (Prerequisites), কিছু সামাজিক ও সামষ্টিক চেষ্টা তৎপরতা এবং কিছু আবেগ উদ্দীপনা ও ঝোঁক প্রবণতা বর্তমান থাকা চাই, যেগুলোর সমন্বিত চাপের মুখে স্বাভাবিক পন্থায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে থাকে। যুক্তি বিদ্যায় সূত্র বিন্যাসের ভিত্তিতে যেমন সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়, রসায়ন শাস্ত্রে রসায়নিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উপাদান সমূহকে বিশেষ পন্থায় সংমিশ্রিত করলে যেমন সেগুলোর সমগুণ সম্পন্ন রসায়নিক পদার্থই প্রস্তুত হয়, ঠিক একইভাবে, সমাজ বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, একটি রাষ্ট্র কেবল সেই পরিবেশের দাবীর ফলশ্রুতিতেই জন্ম লাভ করে, যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় কোনো সমাজে পারস্পারিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে।
আর রাষ্ট্রের প্রকৃতি কি হবে? তাও নির্ভর করে সমাজের সেই পরিবেশ ও দৃষ্টিভংগির উপর, যার চাপের ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্র জন্ম লাভ করবে। যেমন, তর্ক শাস্ত্র এক ধরণের সূত্র বিন্যাসের ফলশ্রুতিতে অন্য ধরণের সিদ্ধান্ত প্রকাশ হতে পারেনা। যেমন, রসায়ন শাস্ত্রে সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন রসায়নিক উপাদান সমূহের সংমিশ্রণে একটি ভিন্নধর্মী যৌগিক পদার্থ তৈরি হতে পারেনা। যেমন, লেবু গাছ লাগানোর পর তা বড় হয়ে আম ফলাতে পারেনা। ঠিক তেমনি উপায় উপাদান এবং কার্যকারণ যদি একটি বিশেষ প্রকৃতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে হয়ে থাকে, আর সেগুলোর সমন্বিত কার্যক্রমও যদি হয় বিশেষ ধরণের রাষ্ট্রেরই আত্মপ্রকাশের অনুকূলে, তাহলে ক্রমবিকাশের পর্যায়সমূহ পার হয়ে রাষ্ট্র যখন পূর্ণতা লাভের দ্বার প্রান্তে উপনীত হবে, তখন এসব উপায় উপাদান ও কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, তা কিছুতেই হতে পারেনা।
এ বক্তব্য থেকে আপনারা আমাকে অদৃষ্টবাদের (Determinism) প্রবক্তা মনে করবেন না। একথাও মনে করবেন না যে, আমি মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধিকারকে অস্বীকার করছি। নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারণে ব্যক্তি ও সমষ্টির ইচ্ছাশক্তি এবং কার্যক্রমের ভূমিকা বিরাট। কিন্তু আমি আসলেই একটি কথাই প্রমাণ করার চেষ্টা করছি। আর তাহলো, যে ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থাই সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য হবে, প্রথম থেকেই ঠিক সে ধরণের রাষ্ট্রের স্বভাব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল উপায় উপাদান সংগ্রহ করা এবং ঠিক সে লক্ষ্যেই পৌঁছুবার মতো কর্মপন্থা অবলম্বন করা একান্ত অপরিহার্য।
আমরা যে বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, সে প্রকৃতির রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে অবশ্যি ঠিক সে রকম আন্দোলন সৃষ্টি হতে হবে। সে ধরণের ব্যক্তিগত, দলীয় ও সামাজিক চরিত্র সৃষ্টি করতে হবে। সে ধরণের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতৃত্ব এবং সে রকম সামাজিক কার্যক্রম ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ, এগুলো এই বিশেষ ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক দাবী। এসব উপায় উপাদান ও কার্যকারণের যখন সমন্বিতভাবে সংগৃহীত ও হস্তগত হয় এবং এক দীর্ঘ প্রাণান্তকর চেষ্টা সংগ্রামের পর তাদের মধ্যে এমন অপ্রতিরোধ্য শক্তি বলিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়ে যায়, যার ফলে তাদের গড়া এই সমাজে অন্য কোনো ধরণের বাতিল ব্যবস্থার পক্ষে বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন এর অপরিহার্য স্বাভাবিক পরিণতিতে সেই বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থারই আত্মপ্রকাশ ঘটে, যার জন্যে এই সকল উপায় উপাদান ও কার্যকারণের শক্তি সমন্বিত ও সমষ্টিগতভাবে চেষ্টা সংগ্রাম চালিয়েছে।
যেমন একটি বীজ। তার থেকে অংকুরিত হলো একটি গাছ। যার অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহ তাকে প্রতিপালিত করে পৌঁছে দিলো একটি পর্যায়ে। তখন এ গাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে সেই ফলই ফলতে থাকবে, যা ফলানোর জন্যে তার অভ্যন্তরীণ শক্তি ও উপায় উপাদানসমূহ দীর্ঘদিন ধরে রসসিঞ্চন করে আসছিল। এই অতি সত্যি বিষয়টি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে আপনাকে একটি কথা স্বীকার করে নিতেই হবে। তাহলো, আন্দোলন, নেতৃত্ব, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক চরিত্র এবং কর্মপদ্ধতি ও কর্মকৌশলসহ প্রতিটি উপাদান যেখানে একটি বিশেষ ধরণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সম্পূর্ণ অনুকূল ও উপযোগী তৎপরতায় বলিষ্ঠভাবে সক্রিয়, এ সবের পরিণামে সেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার আশা করাটা মুর্খতা, খামখেয়ালী, অসার কল্পনা এবং অনভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নাই।
আদর্শিক রাষ্ট্র (Ideological State)
আমরা যে রাষ্ট্রকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বলে আখ্যায়িত করেছি, তার প্রকৃত রূপটা কি? কি তার প্রকৃতি? কি তার ধরণ? কি তার বৈশিষ্ট্য ও আসল পরিচয়? – তা আমাদের ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, জাতীয়তাবাদের নাম গন্ধও এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ জিনিসটিই ইসলামী রাষ্ট্রকে অন্য সব ধরণের রাষ্ট্র থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। এ হচ্ছে নিছক একটি আদর্শিক রাষ্ট্র। এ ধরণের রাষ্ট্রকে আমি ইংরেজীতে ‘IDEOLOGICAL STATE’ বলবো। এমন আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রের সাথে মানুষ সব সময় পরিচিত ছিল না। আজও পৃথিবীতে এ ধরণের কোন আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত নেই। প্রাচীনকালে মানুষ বংশীয় বা শ্রেণীগত রাষ্ট্রের সাথে পরিচিত ছিলো। অতপর গোত্রীয় এবং জাতীয় রাষ্ট্রের সাথে পরিচিত হয়। এমন একটি আদর্শিক রাষ্ট্রের কথা মানুষ তার সংকীর্ণ মানসিকতায় কখনো স্থান দেয়নি, যার আদর্শ গ্রহণ করে নিলে বংশ, গোত্র, জাতি ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশীদার হয়ে যাবে।
খৃষ্টবাদ এর একটি অস্পষ্ট নকশা লাভ করেছিল। কিন্তু সেই পূর্ণাঙ্গ চিন্তা কাঠামো তারা লাভ করেনি, যার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ফরাসী বিপ্লবে আদর্শিক রাষ্ট্রের একটি ক্ষীণ রশ্মি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল বটে, কিন্তু তা অচিরেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের অন্ধ গহবরে তলিয়ে যায়। কমিউনিজম আদর্শিক রাষ্ট্রের ধারণা বিশেষভাবে প্রচার করে। এমনকি এ মতবাদের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রের বুনিয়াদ স্থাপনেরও কোশেশ করে। এর ফলে বিশ্ববাসীর মনে আদর্শিক রাষ্ট্রের ক্ষীণ ধারণাও জন্ম নিতে থাকে। কিন্তু অবশেষে এর ধমনীতেও ঢুকে পড়লো জাতীয়তাবাদের যাবতীয় তীর্যক ভাবধারা। জাতীয়তাবাদ কমিউনিজমের আদর্শিক ধারণাকে ভাসিয়ে নিয়ে ডুবিয়ে দিলো সমুদ্রের তলদেশে।
পৃথিবীর প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র ইসলামই হচ্ছে একমাত্র সেই আদর্শ নীতি, যা জাতীয়তাবাদের যাবতীয় সংকীর্ণ ভাবধারা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নিরেট আদর্শিক বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। আর একমাত্র ইসলামই হচ্ছে সেই মহান আদর্শ, যা গোটা মানব জাতিকে তার এই আদর্শ গ্রহণ করে অজাতীয়তাবাদী বিশ্বজনীন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানায়।
বর্তমান বিশ্বে যেহেতু এমন একটি রাষ্ট্রের ধারণা অপরিচিত এবং যেহেতু বিশ্বের সবগুলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবস্থা এ ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত, তাই কেবল অমুসলিমরাই নয়, স্বয়ং মুসলমানরা পর্যন্ত এমন একটি রাষ্ট্র এবং এর অন্তর্নিহিত ভাবধারা (IMPLICATIONS) অনুধাবন করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। যারা মুসলমানের ঘরে জন্ম নিয়েছে বটে, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার ধারণা গ্রহণ করেছে পুরোপুরিভাবে ইউরোপীয় ইতিহাস, রাজনীতি, ও সমাজ বিজ্ঞান (Social science) থেকে, তাদের মন মস্তিষ্কে এ ধরণের আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা কিছুতেই স্থান পায় না। উপমহাদেশের বাইরেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেসব দেশেও এ ধরণের লোকদের হাতেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব এসেছে। জাতীয় রাষ্ট্র (National State) ছাড়া আর কোনো ধরণের রাষ্ট্রের কথা কল্পনাও করতে পারেনা। কারণ, তাদের মনমস্তিষ্ক তো ইসলামের জ্ঞান, চেতনা এবং আদর্শিক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই উপমহাদেশেও যারা সে ধরণের শিক্ষা দীক্ষা লাভ করেছে, তারাও এ জটিল সমস্যায় জর্জরিত।
ইসলামী রাষ্ট্রের নাম মুখে এরা উচ্চারণ করে বটে, কিন্তু যে শিক্ষা দীক্ষায় বেচারাদের মস্তিষ্ক গঠিত হয়েছে, তা থেকে ঘুরে ফিরে কেবল সেই ‘জাতীয় রাষ্ট্রের’ চিত্রই বারবার তাদের সামনে ভেসে উঠে। জ্ঞানত কিংবা অজ্ঞতাবশতঃ এরা কেবল জাতি পূজার (Nationalistic Ideology) বেড়াজালেই ফেঁসে যায়। তারা যে পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর কথাই চিন্তা করুক না কেন, তা করে থাকে জাতীয়তাবাদেরই ভাবধারার ভিত্তিতে। ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ গতানুগতিক ধারণা পোষণ করে।
তারা মনে করে, ‘মুসলমান’ নামের যে ‘জাতিটি’ রয়েছে, তার হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কিংবা অন্তত রাজনৈতিক নেতৃত্ব এলেই তা ইসলামী রাষ্ট্র হবে। আর এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে তারা যতোই চিন্তাভাবনা করে, অন্যান্য জাতির অবলম্বিত কর্মপন্থা ছাড়া নিজেদের সেই জাতিটির জন্যে অন্য কোন কর্মপন্থাই তাদের নজরে পড়েনা। এই ধারণাই তাদের মগজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতি যেসব উপায় উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, তারাও ওসব উপায় উপাদানের সমন্বয়েই তাদের জাতিটিকে গঠন করবে। তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করে দেয়া হবে। ১ তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি করা হবে। জাতীয় গার্ডবাহিনী সংগঠিত করা হবে। গঠন করা হবে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী। যেখানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, সেখানে গণতন্ত্রের স্বীকৃত নীতি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন’ (Majority Rule) এর ভিত্তিতে তাদের জাতীয় রাষ্ট্র সংগঠিত হবে। আর সেখানে তারা সংখ্যালঘু, সেখানে তাদের ‘অধিকার’ সংরক্ষিত হবে।
তারা মনে করে, তাদের স্বাতন্ত্র্য ঠিক সেভাবে সংরক্ষিত হওয়া উচিত, যেভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিটি সংখ্যালঘু জাতি (National Minority) নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে চায়। তারা চায়, শিক্ষা, চাকুরী এবং নির্বাচনী সংস্থাসমূহে নিজেদের কোটা নির্ধারিত হবে। নিজেদের প্রতিনিধি নিজেরা নির্বাচন করবে। ইত্যাদি ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী চিন্তা তাদের চিন্তা শক্তিকে গ্রাস করে রেখেছে। এসব জাতীয়তাবাদী চিন্তা প্রকাশ করার সময় তার উম্মাহ্, জামায়াত, মিল্লাত, আমীর ইতায়াত প্রভৃতি ইসলামী পরিভাষাই মুখে উচ্চারণ করে। কিন্তু এই শব্দগুলো তাদের কাছে জাতীয় ধর্মবাদের জন্যে ব্যবহৃত শব্দাবলীরই সমার্থক। সৌভাগ্যবশতঃ তারা এ শব্দগুলো পুরানো ভান্ডারে তৈরি করাই পেয়ে গেছে এবং এগুলো দিয়ে তাম্র মুদ্রার উপর স্বর্ণমুদ্রার মোহরাংকিত করার সুবিধে পাচ্ছে।
আপনারা যদি আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রের সঠিক পরিচয় উপলব্ধি করে নিতে পারেন, তাহলে একথাটি বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না যে, এ ধরণের জাতীয়তাবাদী চিন্তাপদ্ধতি, কার্যসূচি তো দূরের কথা, বরঞ্চ এ মহান কাজের সূচনাই হতে পারেনা। সত্য কথা বলতে কি, জাতীয়তাবাদের প্রতিটি অংগ একেকটি তীক্ষ্মধার কুঠারের মতো, যা আদর্শিক রাষ্ট্রের মূলে কুঠারাঘাত করে, তাকে বিনাশ করে দেয়।
আদর্শবাদী রাষ্ট্র যে ধারণা (IDEA) পেশ করে, তার মূল কথাই হচ্ছে, আমাদের সামনে ‘জাতি’ বা ‘জাতীয়তাবাদের’ কোনো অস্তিত্ব নেই। আমাদের সামনে রয়েছে শুধু মানুষ বা মানব জাতি। তাদের কাছে আমরা এক মহান আদর্শ এ উদ্দেশ্যে পেশ ও প্রচার করবো যে, এ আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত হবার মধ্যেই তাদের সকলের কল্যাণ ও সাফল্য নিহিত রয়েছে। এই আদর্শ গ্রহণকারী সকল মানুষ ঐ আদর্শিক রাষ্ট্রটি পরিচালনায় সমান অংশীদার।
এবার একটু চিন্তা করে দেখুন, যে ব্যক্তির মন মগজ, ভাষা বক্তব্য, কাজ কর্ম, তৎপরতা প্রভৃতি প্রতিটি জিনিসের উপর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও জাতিপূজার মোহরাংকিত হয়ে আছে, সে কী করে এই মহান বিশ্বজনীন আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলতে সক্ষম হবে? সংকীর্ণ জাতি পূজায় অন্ধ বিভোর হয়ে সে নিজের হাতেই তো বিশ্বমানবতাকে আহ্বান জানাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রথম কদমেই তো সে নিজের পজিশনকে ভ্রান্তির বেড়াজালে নিমজ্জিত করেছে। বিশ্বের যেসব জাতি জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে আছে, জাতিপূজা এবং জাতীয় রাষ্ট্রই যাদের সমস্ত ঝগড়া লড়াইর মূল কারণ, তাদের পক্ষে বিশ্ব মানবতাকে কল্যাণের আদর্শের প্রতি আহ্বান করা সম্ভব নয়। যারা নিজেদের জাতীয় রাষ্ট্র এবং নিজ জাতির অধিকারের জন্যে ঝগড়ায় নিমজ্জিত, তারা কি বিশ্ব মানবতার কল্যাণের কথা চিন্তা করতে পারে? লোকদেরকে মামলাবাজী থেকে ফিরানোর আন্দোলন আদালতে মামলা দায়ের করার মাধ্যমে আরম্ভ করা কি যুক্তি সংগত কাজ হতে পারে?
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্র
ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, তার গোটা অট্টালিকা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণার মূল কথা হলো, বিশ্ব সাম্রাজ্য আল্লাহর। তিনিই এ বিশ্বের সার্বভৌম শাসক। কোনো ব্যক্তি, বংশ, শ্রেণী, জাতি, এমনকি গোটা মানবজাতিরও সার্বভৌমত্বের (Sovereignty) বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। আইন প্রণয়ন এবং নির্দেশ দানের অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট।
এই রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ হচ্ছে, এখানে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে। আর এ প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা মানুষ সঠিকভাবে লাভ করতে পারে মাত্র দুটি পন্থায়। হয়তো আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো মানুষের নিকট আইন ও রাষ্ট্রীয় বিধান অবতীর্ণ হবে এবং তিনি তা অনুসরণ ও কার্যকর করবেন। কিংবা মানুষ সেই ব্যক্তির অনুসরণ ও অনুবর্তন করবে, যার নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আইন ও বিধান অবতীর্ণ হয়েছে।
এই খিলাফত পরিচালনার কাজে এমন সব লোকই অংশীদার হবে, যারা এই আইন ও বিধানের প্রতি ঈমান আনবে এবং তা অনুসরণ ও কার্যকর করার জন্যে প্রস্তুত থাকবে। তাদেরকে এরূপ স্থায়ী অনুভূতির সাথে এ মহান কাজ পরিচালনা করতে হবে যে, সামষ্টিকভাবে আমাতের সকলকে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককে এর জন্যে সেই মহান আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে, গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছুই যার অবগতিতে রয়েছে। যার জ্ঞানের বাইরে কোন কিছুই গোপন নেই।
এই চিন্তা প্রতিটি মূহুর্ত তাদের এ অনুভূতিকে জাগ্রত রাখবে যে, মানুষের উপর নিজেদের হুকুম ও কর্তৃত্ব চালানোর জন্যে, জনগণকে নিজেদের গোলাম বানানোর জন্যে, তাদেরকে নিজেদের সম্মুখে মাথা নত করতে বাধ্য করার জন্যে, তাদের থেকে ট্যাক্স আদায় করে নিজেদের জন্যে বিলাসবহুল আট্টালিকা নির্মাণ করার জন্যে, আর স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিলাসিতা, আত্মপূজা এবং হঠকারিতার সামগ্রী পূঞ্জিভূত করার জন্যে আমাদের উপর খিলাফতের এই মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়নি। বরঞ্চ এই বিরাট দায়িত্ব আমাদের উপর এই জন্যে অর্পিত হয়েছে, যেনো আমরা আল্লাহর বান্দাদের উপর তাঁরই দেয়া ইনসাফ ভিত্তিক আইন ও বিধান কার্যকর করি এবং নিজেরা নিজেদের জীবনে তা পুরোপুরি অনুসরণ ও কার্যকর করি। এই বিধানের অনুসরণ এবং তা কার্যকর করার ব্যাপারে আমরা যদি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করি, এ কাজে যদি অনূ পরিমাণ স্বার্থপরতা, স্বেচ্ছাচারিতা, বিদ্বেষ, পক্ষপাতিত্ব, কিংবা বিশ্বাসঘাতকতার অনুপ্রবেশ ঘটাই, তাহলে আল্লাহর আদালতে এর শাস্তি অবশ্যি আমাদেরকে ভোগ করতে হবে, দুনিয়ার জীবনে শাস্তি ভোগ থেকে যতোই মুক্ত থাকি না কেন?
এই মহান আদর্শের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় অট্টালিকা তার মূল ও কান্ড থেকে আরম্ভ করে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর শাখা প্রশাখা পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে ধর্মহীন রাষ্ট্র (Secular States) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে থাকে। তার গঠন প্রক্রিয়া, স্বভাব প্রকৃতি সবকিছুই সেক্যুলার রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন এক বিশেষ ধরণের মানসিকতা। এক স্বাতন্ত্রধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এক অনুপম কর্মনৈপূণ্য। এ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, কোর্ট কাচারী, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আইন কানুন, কর ও খাজন পরিচালনা পদ্ধতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ, সন্ধি প্রভৃতি সব বিষয়ই ধর্মহীন রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ইসলামী রাষ্ট্রের কেরানী, এমনকি চাপরাশী হবারও যোগ্য নয়। সে রাষ্ট্রের পুলিশ ইনস্পেক্টর জেনারেল (ওএচ) ইসলামী রাষ্ট্রের একজন সাধারণ কনস্টেবল হবারও যোগ্যতা রাখেনা। ধর্মহীন রাষ্ট্রের ফিল্ড মার্শাল এবং জেনারেলরা ইসলামী রাষ্ট্রে সাধারণ সিপাহী পদেও ভর্তি হবার যোগ্যতা রাখেনা। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো পদ পাওয়া তো দূরের কথা, তার মিথ্যাচার, ধোকাবাজি এবং বিশ্বসাঘাতকতার কারণে হয়তো কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়া থেকেও সে রক্ষা পাবেনা।
মোট কথা, ধর্মহীন সেক্যুলার রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী করে যেসব লোক তৈরি করা হয়েছে এবং সে ধরণের রাষ্ট্রের স্বভাব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ অযোগ্য। ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক, ভোটার, কাউন্সিলার, কর্মকর্তা, সিপাহী, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, বিভিন্ন বিভাগীয় কর্মকর্তা, সেনা প্রধান, রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রীবর্গ, মোটকথা নিজেদের সমজা জীবনের প্রতিটি বিভাগ, পরিচালিকা যন্ত্রের প্রতিটি অংশ সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজস্ব আদর্শের ভিত্তিতে ঢেলে সাজাতে হবে।
এ রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজন এমন সব লোকের, যাদের অন্তরে রয়েছে আল্লাহর ভয়। যারা আল্লাহর সম্মুখে নিজেদের দায়ত্ব পালনের বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে বলে তীব্র অনুভূতি রাখে। যারা দুনিয়ার উপর আখিরাতকে প্রাধান্য দেয়। যাদের দৃষ্টিতে নৈতিক লাভ ক্ষতি পার্থিব লাভ ক্ষতির চাইতে অধিক মূল্যবান। যারা সর্বাবস্থায় সেইসব আইন কানুন নিয়মনীতি ও কর্মপন্থার অনুসরণ করবে, যা তাদের জন্যে বিশেষভাবে প্রণীত হয়েছে। তাদের যাবতীয় চেষ্টা তৎপরতার একমাত্র লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। ব্যক্তিগত আর জাতিগত স্বার্থের দাসত্ব আর কামনা বাসনার গোলামীর জিঞ্জির থেকে তাদের গর্দান হবে সম্পূর্ণ মুক্ত। হিংসা বিদ্বেষ আর দৃষ্টির সংকীর্ণতা থেকে তাদের মন মানসিকতা সম্পূর্ণ পবিত্র। ধনসম্পদ ও ক্ষমতার নেশায় যারা উন্মাদ হবার নয়। ধনদৌলতের লালসা আর ক্ষমতার লিপ্সায় যারা কাতর হবার নয়।
এইরূপ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে এমন নৈতিক বলিষ্ঠতার অধিকারী একদল লোক প্রয়োজন, পৃথিবীর ধনভান্ডার হস্তগত হলেও, যারা নিখাঁদ আমানতদার প্রমাণিত হবে। ক্ষমতা হস্তগত হলে জনগণের কল্যাণ চিন্তায় যারা বিনিদ্র রজনী কাটাবে। আর জনগণও যাদের সুতীব্র দায়িত্বানুভূতিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণাধীনে নিজেদের জানমাল, ইজ্জত আবরুসহ যাবতীয় ব্যাপারে থাকবে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে প্রয়োজন এমন একদল লোকের, যারা কোনো দেশে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলে সেখানকার লোকেরা গণহত্যা, জনপদের ধ্বংসলীলা, জুলুম নির্যাতন, গুন্ডামী বদমায়েশী এবং ব্যভিচারের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হবেনা। বরঞ্চ বিজিত দেশের অধিবাসীরা এদের প্রতিটি সিপাহীকে পাবে তাদের জানমাল, ইজ্জত আবরু ও নারীদের সতীত্বের পূর্ণ হিফাযতকারী। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এতোটা সুখ্যাতি ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে যে, তাদের সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়নতা, নৈতিক ও চারিত্রিক মূলনীতির অনুসরণ এবং প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি পালনের ব্যাপারে গোটা বিশ্ব তাদের উপরে আস্থাশীল হবে।
এ ধরণের এবং কেবলমাত্র এধরণের লোকদের দ্বারাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কেবলমাত্র এরূপ লোকেরাই ইসলামী হুকুমাত পরিচালনা করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে বস্তুবাদী স্বার্থান্বেষী (Utilitarian Mentality) লোকদের দ্বারা কিছুতেই একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হতে পারেনা। বরং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এরূপ লোকদের অস্তিত্ব অট্টালিকার অভ্যন্তরে উইপোকার অস্তিত্বের মতোই বিপজ্জনক। এরা পার্থিব স্বার্থ এবং ব্যক্তি ও জাতির স্বার্থে নিত্য নতুন নীতিমালা তৈরি করে। এদের মগজে না আছে আল্লাহর ভয়, না পরকালের। বরঞ্চ তাদের সমগ্র চেষ্টা তৎপরতার এবং নিত্য নতুন পলিসির মূলকথা হচ্ছে কেবলমাত্র পার্থিব লাভ লোকসানের ‘ধান্দা’।
ইসলামের বিপ্লবের পদ্ধতি
এতোক্ষণ ইসলামী রাষ্ট্রের যে রূপরেখা অংকন করা হলো, তার পুরো চিত্র স্মরণ রেখে চিন্তা করে দেখুন, এই লক্ষ্যে পৌঁছুবার সত্যিকার কর্মপন্থা কি হতে পারে? আগেই বলেছি, কোনো একটি সমাজের মধ্যকার নৈতিক চরিত্র, চিন্তা চেতনা, মন মানসিকতা, সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যগত কার্যকারণের সমন্বিত কর্ম প্রক্রিয়ার ফল স্বরূপ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নিয়মে ঠিক সে ধরণের একটি রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে। একটি গাছ অংকুরিত হওয়া থেকে আরম্ভ করে পূর্ণাঙ্গ গাছে পরিণত হওয়া পর্যন্ত যদি তা লেবু গাছ হিসাবে পরিগঠিত হয়ে থাকে, তবে ফল ফলানোর সময় হঠাৎ করে সে গাছে কিছুতেই আম ফলাতে পারেনা। ঠিক তেমনি, ইসলামী রাষ্ট্রেরও অলৌকিকভাবে আবির্ভাব ঘটেনা।
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে প্রথমে এমন একটি আন্দোলনের প্রয়োজন, যার বুনিয়াদ নির্মিত হবে সেই জীবন দর্শন, সেই জীবনোদ্দেশ্য, সেই নৈতিক মানদন্ড এবং সেই চারিত্রিক আদর্শের উপর, যা হবে ইসলামের প্রাণশক্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কেবল সেসব লোকেরাই ঐ আন্দোলনের নেতা ও কর্মী হবার যোগ্যতা রাখবে, যারা মানবতার এ বিশেষ ছাঁচে ঢেলে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে প্রস্তুত হবে। সেই সাথে যারা সমাজে অনুরূপ মনমানসিকতা ও নৈতিক প্রাণশক্তি প্রচারের জন্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাবে।
অতঃপর এই একই ভিত্তির উপর এমন এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা ঐ বিশেষ টাইপের লোক তৈরি করবে। যা থেকে সৃষ্টি হবে এমন সব মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, মোটকথা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় এমন সব বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে, যারা নিজেদের মনমানসিকতা, ধ্যানধারণা ও চিন্তা দর্শনের দিক থেকে হবে পূর্ণ মুসলিম। যাদের ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে বাস্তবধর্মী এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নীল নকশা তৈরি করার থাকবে পূর্ণাঙ্গ যোগ্যতা। যারা খোদাদ্রোহী চিন্তানায়কদের মোকাবেলায় নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব (Intellectual leadership) -কে বিজয়ী ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার পূর্ণ যোগ্যতা রাখবে।
এই চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতেই ইসলামী আন্দোলনকে সমাজের বুকে ছড়িয়ে থাকা ভ্রান্ত জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রামে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে বিপদ মুসীবত ও অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে, ত্যাগ ও কুরবানীর নজরানা পেশ করে, মার খেয়ে খেয়ে এবং জীবন দিয়ে দিয়ে নিজেদের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও মজবুত সংকল্পের প্রমাণ পেশ করতে হবে। যেনো কোনো প্রকার লোক তাদের নিখাঁদ খাঁটি (Finest standard) সোনাই দেখতে পায়। সংগ্রামের ময়দানে যে আদর্শের পতাকাবাহী হিসেবে তারা অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের প্রতিটি কথা ও কাজে সে আদর্শ প্রতিফলিত হতে হবে। তাদের প্রতিটি কথা দ্বারা যেনো দুনিয়ার সামনে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এমন নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ, সত্যবাদী, পূতঃ চরিত্র, ত্যাগী, নীতিবান ও খোদাভীরু লোকেরা মানবতার কল্যাণের জন্যে যে আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে, তাতে অবশ্যি মানুষের জন্যে সুবিচার, শান্তি ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
এ ধরণের চেষ্টা সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজের এমন সব লোকই ধীরে ধীরে এই আন্দোলনে শরীক হয়ে যাবে, যাদের প্রকৃতিতে সত্য ও সততার কিছু না কিছু উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। এর মোকাবেলায় হীন চরিত্র ও নিকৃষ্ট পথের অনুসারীদের প্রভাব ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যেতে থাকবে। জনগণের চিন্তা চেতনায় সৃষ্টি হবে এক প্রচন্ড বিপ্লব। সমাজ জীবনে উত্থিত হবে সেই বিশেষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার তীব্র দাবী। তখন এই পরিবর্তিত মানসিকতার সমাজে অপর কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু থাকার পথ হয়ে যাবে সম্পূর্ণ রুদ্ধ।
অবশেষে, এক অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পরিণতির ফলে সেই কাংখিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে জমীনকে তৈরি করা হয়েছে। এভাবে সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার বদৌলতে, তা পরিচালনার জন্যে একেবারে নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী থেকে নিয়ে মন্ত্রী ও গভর্ণর পর্যায় পর্যন্ত সকল শ্রেণীর কর্মচারী ও কর্মকর্তা সেখানে মজুদ পাওয়া যাবে।
এ হলো সেই বিপ্লবের চিত্র ও সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বাভাবিক পদ্ধতি, যাকে ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী রাষ্ট্র বলা হয়। পৃথিবীর সব বিপ্লবের ইতিহাস আপনাদের সামনে রয়েছে। একথা আপনাদের অজানা থাকার কথা নয় যে, একটি বিশেষ ধরণের বিপ্লব ঠিক সেই ধরণের আন্দোলন, অনুরূপ নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী, অনুরূপ সামষ্টিক ও সামাজিক চেতনা এবং অনুরূপ সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পরিবেশই দাবী করে।
ফরাসী বিপ্লবের জন্যে সেই বিশেষ ধরণের নৈতিকও মানসিক ভিত রচনারই প্রয়োজন ছিলো, যা তৈরি করেছিলেন রুশো, ভল্টেয়ার ও মন্টেস্কোর মতো দার্শনিক। কার্ল মার্ক্সের দর্শন এবং লেলিন ও ট্রটক্সির নেতৃত্ব আর হাজার হাজার সমাজতান্ত্রিক কর্মীর ত্যাগের বদৌলতেই রুশ বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল, যারা নিজেদের জীবনকে সমাজতন্ত্রের ছাঁচে ঢেলে গঠন করেছিলো। জার্মানীর জাতীয় সমাজতন্ত্রের পক্ষে সেই বিশেষ নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও সাংস্কৃতিক মাটিতেই শিকড় গাড়া সম্ভব হয়েছিল, যা সৃষ্টি করেছিল হেগেল, ফিস্টে, গ্যেটে এবং নিটশের মতো অসংখ্য চিন্তাবিদদের দর্শন ও মতাদর্শ, আর হিটলারের দুর্ধর্ষ নেতৃত্ব। ঠিক তেমনি, ইসলামী বিপ্লবও কেবল তখনি সংঘটিত হতে পারবে, যখন কুরআনী দর্শন ও মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহর (সঃ) আদর্শের ভিত্তিতে একটি প্রচন্ড গণআন্দোলন উত্থিত হবে এবং সামাজিক জীবনের মানসিক, নৈতিক, মনস্তাত্বিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিসমূহকে সংগ্রামের প্রচন্ডতায় আমূল পরিবর্তিত করে দেয়া সম্ভব হবে।
একথা অন্তত আমার বুঝে আসেনা যে, কোনো জাতিপূজা ধরণের আন্দোলন দ্বারা কি করে ইসলামী বিপব সংগঠিত হতে পারে? কারণ, এর পটভূমিতে তো রয়েছে সেই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, যা বর্তমানে আমাদের দেশে চালু রয়েছে। আর এই শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি তো সুবিধাবাদী নৈতিকতা (Utilitarian Morals) এবং প্রয়োগবাদী (Pragmatism) মানসিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। সাবেক ফরাসী প্রধানমন্ত্রী মসিয়ে রোনোর মতো অলৌকিক পন্থায় আমি বিশ্বাস করিনা। আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী যে, চেষ্টা সংগ্রাম যেমন হবে, ফলও ঠিক সে রকমই হবে।
অবাস্তব ধারণা- কল্পনা
কিছু লোকের ধারণা, মুসলমানরা সংগঠিত হলেই তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারা মনে করেন, মুসলমানরা এক কেন্দ্রে, এক প্লাটফরমে এবং একক নেতৃত্বের অধীনে একত্রিত হয়ে গেলেই “ইসলামী রাষ্ট্র” কিংবা “স্বাধীন ভারত স্বাধীন ইসলাম” এর উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। কিন্তু মূলত এটাও জাতিপূজা ধরণেরই প্রোগ্রাম। এভাবে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। জাতি হিসাবে যারাই নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, নিঃসন্দেহে এধরণের প্রোগ্রামই তারা গ্রহণ করবে। চাই তারা হিন্দু জাতি হোক, বা শিখ। কিংবা জার্মান হোক বা ইতালীয়। আসলে, জাতির প্রেমে নিমজ্জিত নেতা ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারদর্শী হয়ে থাকে। কর্তৃত্ব চালানো এবং দল পরিচালনার যোগ্যতা পুরোমাত্রায় তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। যে কোন জাতির মস্তক উন্নত করার ব্যাপারে এ ধরণের নেতা খুবই উপযোগী হয়ে থাকে। চাই সে হিটলার হোক কিংবা মুসোলিনী। অনুরূপ হাজরো লাখো নওজোয়ান যদি এ ধরণের কেনো নেতার নেতৃত্বে সুশৃংখলভাবে আন্দোলন করতে পারে, তবে বিশ্বের বুকে যে কোন জাতির শির উন্নত হতে পারে। চাই তারা জাপানী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হোক, কিংবা চৈনিক, তাতে কিছুই যায় আসে না।
একইভাবে “মুসলমান” যদি একটি বংশগত কিংবা ঐতিহাসিক জাতির নাম হয়ে থাকে আর উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে সেই জাতিটির উন্নতি সাধন, তবে তার বাস্তব সম্মত উপায় সেটাই, যা প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর ফলে একটি জাতীয় রাষ্ট্রও অর্জিত হতে পারে। কিংবা কমপক্ষে দেশ শাসনে ভাল একটা অংশীদারিত্ব লাভ হতে পারে। কিন্তু ইসলামী বিপব এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিক থেকে এটাকে প্রথম পদক্ষেপও বলা যেতে পারেনা। বরঞ্চ এ এক বিপরীত পদক্ষেপ।
বর্তমানে মুসলমান নামে যে জাতিটি এদেশে বাস করছে, তাতে ভালমন্দ সকল প্রকার লোকই বিদ্যমান রয়েছে। চরিত্রগত দিক থেকে কাফিরদের মধ্যে যতো প্রকার লোক পাওয়া যায়, ততো প্রকার লোক এ জাতিটির মধ্যেও বর্তমান। কোনো কাফির জাতি আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে যত লোক যোগাড় করতে পারবে, সম্ভবত এ জাতিটিও সে কাজের জন্যে ততো লোক একত্র করতে পারবে। সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, জিনা, ব্যভিচার, মিথ্যা ও ধোকাবাজিসহ যাবতীয় নৈতিক অপরাধের কাজে এ জাতিটি কাফিরদের থেকে কিছুমাত্র কম পারদর্শী নয়। পেট ভর্তি করা এবং অর্থ উপার্জনের জন্যে কাফিররা যতো পথ অবলম্বন করে, এ জাতির লোকেরাও ঠিক ততো পথই অবলম্বন করে। জেনে বুঝে নিজ মোয়াক্কেলকে জিতানোর জন্যে একদল মুসলিম উকিল প্রকৃত সত্যকে চাপা দেবার সময় ঠিক ততোটাই খোদার ভয়হীন হয়ে থাকে, যতোটা হয়ে থাকে একজন অমুসলিম আইনজীবি। একজন মুসলিম ধনশালী সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা এবং একজন মুসলিম শাসক ক্ষমতার দাপটে ঠিক সেসব কাজই করে, যা করে থাকে অমুসলিম ধনী আর শাসকরা।
যে জাতি নৈতিক দিক থেকে এতোটা অধঃপতিত হয়েছে, তার সব ধরণের জগাখিচুড়ী চরিত্রের লোকদের একত্রিত ও সংগঠিত করে দিলেই, কিংবা রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে শৃগালের মতো চাতুর্য শিখিয়ে, অথবা সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নেকড়ের মতো হিংস্র করে গড়ে তোলার মাধ্যমে জংগলের কর্তৃত্ব লাভ করা হয়তো সহজ হতে পারে। কিন্তু আমার কিছুতেই বুঝে আসেনা, তাদের দ্বারা আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করার কাজ কিভাবে সম্ভব হতে পারে? এমতাবস্থায় কে তাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দেবে? কে হবে তাদের সম্মুখে শ্রদ্ধাবনত? তাদের দেখে কার অন্তর হবে ইসলামের জন্যে আবেগাপ্লুত? তাদের “পবিত্র জীবন ধারার” মাধ্যমে ‘ইয়াদখুলূনা ফি দ্বীনিল্লাহী আফওয়াজা’-এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য কিভাবে দেখানো যেতে পারে? কোথায় স্বীকৃতি পাবে তাদের আধ্যাত্বিক নেতৃত্ব? নিজেদের মুক্তির জন্যে বিশ্বের কোন্ লোকেরা তাদের স্বাগত জানাবে?
আল্লাহর কালেমা বিজয় যে জিনিসের নাম, তার জন্যে তো এমন সব কর্মী বাহিনীরই প্রয়োজন, যারা হবে আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। কোনো প্রকার লাভ ক্ষতির পরোয়া না করেই আল্লাহর আইন ও বিধানের উপর যারা থাকবে অটল অবিচল। মূলতঃ আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে এরকম একদল লোকেরই প্রয়োজন। চাই তারা বংশগত মুসলমানের মধ্য থেকেই এগিয়ে আসুক, কিংবা আসুক অপর কোনো জাতি থেকে, তাতে কিছুই যায় আসেনা। আমাদের জাতির উপরে বর্ণিত ধরণের পঁচিশ পঞ্চাশ লাখ লোকের মেলা অপেক্ষা এরকম দশজন মর্দে মুমিন আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে অধিকতর মূল্যবান। সেরকম বিপুল তাম্রমুদ্রার ভাণ্ডার ইসলামের কোন কাজে আসবে না, যেগুলোর উপর স্বর্ণমুদ্রার মোহরাংকিত করা হয়েছে। মুদ্রার এইসব বহিরাংকন দেখার আগে ইসলাম জানতে চায়, এগুলোর অভ্যন্তরেও সত্যিই সোনা আছে কি? জাল স্বর্ণমুদ্রার বিরাট স্তুপ অপেক্ষা আল্লাহর দ্বীনের কাজে একটি খাঁটি স্বর্ণমুদ্রাও অধিকতর মুল্যবান।
এছাড়া আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার আন্দোলনের জন্যে প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা সেইসব নীতিমালা থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হতে প্রস্তুত নয়, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্যে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। এই আদর্শিক দৃঢ়তার ফলে সকল মুসলমানকে যদি না খেয়েও মরতে হয়, এমনকি তাদেরকে যদি হত্যাও করা হয়, তবু তাদের নেতৃবৃন্দ বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি বরদাশত করতে প্রস্তুত হবেনা।
যে নেতৃত্ব কেবল জাতির স্বার্থ দেখে, আদর্শকে জলাঞ্জলী দিয়ে জাতির লাভালাভের জন্যে যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধাবোধ করেনা এবং যার অন্তর খোদার ভয়শূন্য, আলাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান কাজে তা যে নিরেট অযোগ্য, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
অতঃপর দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা দেখুন। ‘হাওয়ার গতি যে দিকে, চলো সবে সেদিকে’, এই বিখ্যাত প্রবাদটির উপর বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত। এই শিক্ষা ব্যবস্থা এ মহান ইসলামের সেবার জন্যে কি করে উপযুক্ত হতে পারে, যার অটুট ফয়সালা হচ্ছেঃ হাওয়ার গতি যেদিকেই বয়ে যাক না কেনো, তোমাদেরকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর নির্ধারিত পথেই চলতে হবে।
আমি অত্যন্ত আস্থার সাথে আপনাদেরকে বলছি, আপনাদের হাতে একখন্ড স্বাধীন ভূমির কর্তৃত্ব পরিচালনার দায়িত্ব যদি অর্পণও করা হয়, আপনারা মাত্র একদিনও সে রাষ্ট্রটি ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে চালাতে সক্ষম হবেননা। একটি ইসলামী রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী, আইন আদালত, সামরিক বাহিনী, রাজস্ব, অর্থব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পররাষ্ট্রনীতি পরিচলানার জন্যে যে ধরণের পরিগঠিত মানসিকতা এবং উন্নত নৈতিক শক্তি সম্পন্ন একদল লোকের প্রয়োজন, তার কোন ব্যবস্থাই আপনারা করেননি। বর্তমানে দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে শিক্ষা প্রদান করা হয়, তা থেকে অনৈসলামী রাষ্ট্রের সচিব এবং মন্ত্রী পর্যন্ত সংগ্রহ করা যেতে পারে। কিন্তু মনে কিছু করবেন না, তা থেকে একটি ইসলামী আদালতের চাপরাসী এবং ইসলামী পুলিশ বাহিনীর জন্যে সাধারণ কনস্টেবল পর্যন্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না।
এই তিক্ত সত্য কথাটি কেবল আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেই প্রযোজ্য নয়। বরঞ্চ আমাদের প্রাচীন মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেও সমানভাবে প্রযোজ্য। এই লোকগুলো তো কোনো প্রকার আন্দোলন এবং বিপ্লবেরই পক্ষপাতী নয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থা এতোটা প্রাচীন ও অকর্মণ্য হয়ে গেছে যে, আধুনিক কালের ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে বিচারপতি, অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা পরিচালক এবং রাষ্ট্রদূত সরবরাহ করার ব্যাপারে তা সম্পূর্ণ অনুপযোগী হযে পড়েছে। এভাবে কোনো একটি দিক থেকেও কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তাদের মন মস্তিষ্কে যে ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো ধারণাই বর্তমান নেই, তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকতে পারেনা।
কেউ কেউ এমন অসার পরিকল্পনাও পোষণ করেন যে, অনৈসলামী ধাঁচে হলেও একবার মুসলমানদের একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক। পরে ধীরে ধীরে শিক্ষা ব্যবস্থা ও নৈতিক চরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে সেটাকে ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা যাবে। কিন্তু ইতিহাস, রাষ্ট্র বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য যা কিছু অধ্যয়ন করেছি, তার ভিত্তিতে আমি বলতে চাই, এ অসার কল্পনার কখনো বাস্তব রূপ লাভ করা সম্ভব নয়। এ অবাস্তব কল্পসা যদি বাস্তব রূপ লাভ করে, তবে আমি মনে করবো সেটা এক অলৌকিক কাজ। একথা আমি আগেও বলেছি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা সমাজ জীবনের গভীর তলদেশ পর্যন্ত শিকড় গেড়ে থাকে।
তাই যতক্ষণ না সমাজ জীবনে বিপ্লব সাধিত হবে, ততোক্ষণ পর্যস্ত কোনো কৃত্রিম পদ্ধতিতে রাষ্ট্র বিপ্লব সাধন করা সম্ভব নয়। হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীযের মতো বিরাট যোগ্যতা সম্পন্ন শাসক পর্যন্ত এ পন্থায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর পক্ষে একটি বিরাট সংখ্যক তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ীর সমর্থক থাকা সত্ত্বেও তিনি যে এ উদ্যোগে ব্যর্থ হলেন, তার কারণ হলো, সামগ্রিকভাবে তখনকার সমাজ এ পরিবর্তন ও বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত ছিলোনা। মুহাম্মাদ তুঘলক এবং আলমগীরের মতো শক্তিশালী বাদশাহগণ নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে উন্নত দ্বীনদারীর অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো প্রকার পরিবর্তন ও বিপ্লব সাধন করতে পারেননি। খলীফা মামুনুর রশীদের মতো পরাক্রমশালী শাসক পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন করা তো দূরের কথা, তার বাহ্যিক রূপটিতে সামান্য পরিবর্তন করতে চেয়েও ব্যর্থকাম হন। এ হচ্ছে সে সময়কার অবস্থা, যখন এক ব্যক্তির শক্তি ও ক্ষমতা অনেক কিছুই করতে পারতো। এমতাবস্থায় গণতান্ত্রিক নীতির উপর যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবে, এই বুনিয়াদী পরিবর্তন সংশোধনের কাজে তা কি করে সাহায্যকারী হতে পারে? একথা কিছুতেই আমার বুঝে আসে না।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা তো সেইসব লোকদের হাতেই আসবে, যারা ভোটারদের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হবে। ভোটারদের মধ্যে যদি ইসলামী চিন্তা ও মানসিকতাই সৃষ্টি না হয়, যথার্থ ইসলামী নৈতিক চরিত্র গঠনের আগ্রহই যদি তাদের না থাকে এবং ইসলামের সেই সুবিচারপূর্ণ অলংঘনীয় মূলনীতিসমূহ তারা মেনে চলতে প্রস্তুত না হয়, যেগুলোর ভিত্তিতে ইসলামী হুকুমাত পরিচালিত হবে, তবে তাদের ভোটে কখনো খাঁটি মুসলমান নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসতে পারবে না। এ পন্থায়তো কেবলমাত্র ঐসব লোকেরাই নেতৃত্ব হাসিল করবে, যারা আদমশুমারী অনুযায়ী মুসলমান বটে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মনীতি এবং কর্মপন্থার দিক থেকে তাদের গায়ে ইসলামের বাতাসও লাগেনি।
স্বাধীন মুসলিম দেশে এ ধরণের লোকদের হাতে নেতৃত্ব আসার অর্থ হচ্ছে আমরা ঠিক সে জায়গায়ই অবস্থান করবো, যেখানে অবস্থান করছিল অমুসলিম সরকার। বরং এ ধরণের মুসলিম সরকার আমাদেরকে তার চাইতেও নিকৃষ্ট অবস্থায় নিয়ে যাবে। কেননা, যে “জাতীয় রাষ্ট্রের” উপর ইসলামের উপর লেবেল প্রদর্শন করা হবে, ইসলামী বিপবের পথ রোধ করার ক্ষেত্রে তার দুঃসাহস হবে অসুমলিমদের চাইতেও অধিক। যেসব কাজে অমুসলিম সরকার কারাদন্ডের শাস্তি প্রদান করে, সেইসব ব্যাপারে এ ধরণের “মুসলিম জাতীয়তাবাদী সরকার” ফাঁসি ও নির্বাসনের শাস্তি প্রদান করবে। এরপরও এধরণের রাষ্ট্র ও সরকারের নেতারা বেঁচে থাকা অবস্থায় থাকবেন। ‘গাজী’ আর মরণের পর ‘রহমাতুল্লাহি আলাইহি’। এধরণের “জাতীয় রাষ্ট্র” ইসলামী বিপ্লবের পক্ষে সামান্যতম সহায়ক হবে বলে চিন্তা করাটাও মারাত্মক ভুল।
প্রশ্ন হলো, সেই রাষ্ট্রেও যদি আমাদেরকে সামাজিক জীবনের বুনিয়াদ পরিবর্তন করার সংগ্রাম করতেই হয় এবং রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়াই নিজেদের ত্যাগ ও কুরবানীর মাধ্যমে তা করতে হয়, তবে আজ থেকেই আমরা সেই কর্মপন্থা অবলম্বন করবোনা কেন? তথাকথিত সেই মুসলিম রাষ্ট্রের অপেক্ষায় কেন আমরা সময় এবং তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় শক্তি ব্যয় করবো, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা জানি, তা আমাদের উদ্দেশ্য হাসিলের পথে কোনো উপকারে আসবে না, বরঞ্চ অনেকটা প্রতিবন্ধকই প্রমাণিত হবে।